চৌধুরী আবদুল হান্নান


আর্থিক খাতের দুর্বৃত্ত! এরা কারা? দুর্বৃত্ত শব্দটার সাথে জড়িয়ে আছে ছিনতাইকারী, চোর-ডাকাতদের নাম যারা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কুখ্যাত। কিন্ত প্রশ্ন হলো, কীভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এদের অনুপ্রবেশ ঘটলো? এ সকল অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ব্যাংক পাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

বহুদিন ধরেই এ দুষ্টচক্র ব্যাংক ব্যবস্হাকে জিম্মি করে রেখেছে। তবে সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় অর্থকে কেন্দ্র করেই, যেখানেই অর্থ বা টাকা রয়েছে সেখানেই অপরাধীদের আনাগোনা থাকবেই ।

ব্যাংক ব্যবস্থা বিভিন্ন বিধি-বিধান-আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং জনগণের জমাকৃত অর্থের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে। তবুও ব্যাংক খাত কীভাবে দুষ্টদের অভয়ারণ্যে পরিনত হলো? উত্তর কারও অজানা নয়।

নামে বেনামে ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া বিপুল অর্থ এখন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের পকেটে। যার কাছে টাকা থাকে সেই ক্ষমতাবান এবং যে অর্থ কষ্টার্জিত নয়, অনায়াসে হাতে এসেছে সে অর্থের ক্ষমতা অনেক বেশি কারণ তা বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য ঘাটে ঘাটে বিতরণ করা সহজ। তারপর যদি থাকেঅপাত্রে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংকারের যোগসাজশ, তা হলে তো কথাই নেই। ইঁদুর আরবিড়ালের বন্ধুত্ব বড়ই ভয়ঙ্কর বার্তা দেয়, তখন বুঝতে হবে সর্বনাশটা আর বেশি দূরে নয় ।

যারা ব্যাংকের টাকা মেরে রাজকীয় জীবন যাপন করেন, বিদেশে অর্থ পাচার করেন তারা জাতির শত্রু। ব্যাংকের নিজস্ব কোনো টাকা নেই, অন্যের টাকায় ব্যবসা করে। চাহিদা মাত্র ফেরত পাওয়ার শর্তে আমানতকারীদের জমাকৃত টাকা ব্যাংকের জীবনী শক্তি ও ব্যবসার মূলধন এবং সে অর্থে ব্যাংকের প্রকৃতমালিক আমানতকারীগণ ।

তাদের জমা টাকা নিয়ে ঋণের নামে ডাকাতদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো ভয়াল কাহিনীআমানতকারীদের খুব একটা জানা নেই ।

যখন আমানতকারী তাঁর জমানো টাকা তুলতে ব্যাংকে গিয়ে ফেরত আসবে, তখনই বুঝতে পারবে ব্যাংকটির দৈন্য দশা কোন পর্যায়ে। যেমন হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এক সময়ের অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশলেবাননে। শত শত গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে নিজেদের জমা টাকা না পেয়ে বিক্ষোভ করছে ।

আমাদের দেশে এমন হয়নি তা নয়, সরকারের হস্তক্ষেপে তা নিরসন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ডুবতে বসা ব্যাংককে তাৎক্ষণিক ভর্তুকি দিয়ে কার্যক্রম সাময়িক সক্রিয় রাখা। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে এসকল ভর্তুকি দেওয়া হয় ।বর্তমানে দেশে কত খেলাপি ঋণ রয়েছে তাঁর সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারবে না কারণ ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর একটি অসুস্থ প্রবণতা রয়েছে ।

বর্তমানে ব্যাংক খাতে ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে যা খেলাপি ঋণের সাথে যোগ করে মোট খেলাপি নির্ণয় করা হয় না। এভাবে তথ্য গোপন করে চলছে জনগণের সাথে এক ধরনের প্রতারণা ।

খেলাপি গ্রাহকদের লক্ষ কোটি টাকা মুদ্রা বাজারে প্রবেশ করে দ্রব্য মূল্যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। পরিশ্রম ছাড়া প্রাপ্ত অবৈধ এ অতিরিক্ত অর্থে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতার জ্বালা ভোগ করতে হচ্ছে প্রতিটিনাগরিককে। ব্যাংক থেকে লুটে নেওয়া অর্থ বাজার সয়লাব করে দিয়ে বাজার-স্হিতিশীলতা নষ্ট করেদিয়েছে যার অভিঘাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভুগছে দেশের ১৭ কোটি মানুষ ।

যাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে, ব্যবসাও ভালো চলছে, অথচ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের নাম নেই, তারাই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি এবং এ সকল ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের অপ্রতিরোধ্য গতি ব্যাংক ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে ।

গত ২ বছরে করোনা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুবিধা কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

করোনাকালে কোনো টাকা জমা না দিলেও ঋণ হিসাবটি খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি, আবার মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমান ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিল হওয়া মানে ঋণ নিয়মিত হয়ে যাওয়া এবং বিশেষ শর্ত আরোপ করা না হলে তাদের আবার নতুন করে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়ার এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করবে না ।

ঋণ খেলাপিদের বাড়তি সুযোগ দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ না করে সুবিধা নেওয়ার জন্য বেশি তৎপর থাকেন তারা এবং অপেক্ষায় থাকেন অবশেষে সুদ মওকুফের আশায় ।

ব্যাংকের টাকা লুটেরাদের, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বেপরোয়া গতি রোধ করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি এবং একই সাথে নেতিয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে সক্রিয় করে তুলতে হবে। চিহ্নিত অর্থ আত্মসাতকারীদের দ্রুত আইনের হাতে তুলে দিতে হবে এবং ব্যাংকের ভিতরে লুকিয়ে থাকা যোগসাজশকারী ঘরের শত্রু কিছু ব্যাংকারকে বিভাগীয় মামলার সম্মুখিন করতে হবে ।

সকল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যেখানে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে সেখানে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকদূরের কথা, এই মুহূর্তে তাদের কার্যক্রম কোনোভাবে টিকিয়ে রাখাই হবে প্রাথমিক কাজ ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।