নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


এ বছর জ্বালানি তেলেরে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে সকল পণ্যের দামের উপর পড়েছে প্রভাব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন কিছুই করার নেই! যেসব পণ্যের উপর তেলের তেমন কোন প্রভাব নেই সেবস পণ্যের দামও বাড়ছে রাতারাতি। তবে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়লেও নজর পড়েছে ভোজ্য তেলের উপর । সাধারণ মানুষের মাঝে বাড়ছে হাহাকার। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নি¤œমধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী যাদের আয়ের পরিবর্তন হচ্ছে না তাদের জীবন চালানোই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জোড়ালো করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যে যার মতো করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলছে। সারা পৃথিবীতেই চলছে চরম অস্থিরতা এ কথা মানতে হবে কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দেশের বাজারের চরম অস্থিরতা অন্য সব কিছুকে হার মানিয়েছে।

করোনা পরবর্তী পৃথিবী যখন স্বাভাবিক হচ্ছিল ঠিক সেসময় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। আবার চীন তাইওয়ান উত্তেজনা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে হয় জতিসংঘ নামক প্রতিষ্ঠানটি রোবটিক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এসব অস্থিরতার কারনে সারা পৃথিবীর ন্যায় আমাদের দেশের অগ্রসরমান অর্থনীতি ভেঙ্গে যাচ্ছে খুব দ্রুত। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কথায় সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা হলেও শংকা তৈরি হয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমীকরণ অত্যন্ত জটিল এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তবে এর মাঝেও সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে আশার আলো দেখাতে হবে জনগণকে। সরকারের দূরদর্শিতা ও আমাদের অক্লান্ত শ্রমে সামনে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা সকলের।

সম্প্রতি বাজার ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাত থেকে একেবারেই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। আমাদের মতো কৃষি নির্ভর দেশে কৃষকরা সুবিধা না পেলে এদেশের অর্থনীতিতে আরো দ্রুত ধস নামবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষককে সহায়তা না করতে পারলে অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করবে। এমনিতেই কৃষকরা কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলমান আমন ধান উৎপাদনে সারা দেশে সারের জন্য একটি অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। অনেক জায়গায় কৃষকরা টাকা দিয়েও সার পায়নি। যদিও সরকার বলেছে সারের সংকট নেই তবে এ কথার প্রয়োগ মাঠে নেই এটা বলা চলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ফসল বাঁচাতে বেশি মূল্যে সার কিনতে হয়েছে। এ মৌসুমে আবার অনেক জায়গায় আমান ধানে পোকার আক্রমন দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমান ধানের উৎপাদন খুব একটা সুখকর হবে না বলেই মনে হয়। এসব অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষি পণ্য যদি উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে দেশে দুর্ভিক্ষের শংঙ্কা তৈরি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। ইত্যেমধ্যে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে যে বাজার ব্যবস্থাপনায় যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করা অতি জরুরি। বিশেষ করে সেচের ডিজেলে সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও সেচ কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃষকদের ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ডিজেল ব্যবহারকারীদের ভর্তুকি দেওয়া হয়না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে দেশে কৃষি উপকরণ সহায়তাপ্রাপ্ত কার্ডধারীর সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের তথ্যমতে দেশে সেচ যন্ত্রের ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪০ জন কৃষক। এর মধ্যে ডিজেল সেচভূক্ত ১ কোটি ২৩ লাখ কৃষক রয়েছেন। বাকিরা বিদ্যুৎ চালিত সেচভূক্ত। সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে ৬৭ লাখ ক্ষুদ্র কৃষককে ৭৪৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার ভুর্তকি দেয়। কিন্তু ভুর্তকির এসব অর্থ সত্যিকার অর্থে যাদের পাওয়ার কথা তারা পাচ্ছে কি না সেটা ভালো করে দেখভাল করা জরুরি। সরকারের যেসব সুবিধা রয়েছে সেইসব সুবিধা যেন প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌঁছে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে কর্তৃপক্ষকে। দেশে ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম হলো বোর যা থেকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগই আসে। আর এ উৎপাদনের ৭০ ভাগই চলে ডিজেলে। অন্য দুটি আউশ ও আমন উৎপাদনের বেশির ভাগই চলে বৃষ্টির পানিতে। আর সম্প্রতি হঠ্যাৎ করে লিটার প্রতি ৩৪ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি উৎপাদনের খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। যদিও ইতোমধ্যে ৫টা করে কমেছে তেলের দাম তবে এতে করে উৎপাদন খরচে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারনে অনেক বর্গা চাষী তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। একটা বিষয় চোখে পড়ার মতো যে বর্তমান সময়ে যাদের অধিক পরিমাণে জমি রয়েছে তারা এক সময় এগুলি বর্গা দিয়ে দিত কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বর্গা চাষী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যার ফলে জমি চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

কৃষি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষকরা উৎপাদন খরচ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গ্রাম্য মাহাজনরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এমনিতে কৃষকরা উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে সবসময়। বিশ্ব পরিস্থিতিতে সারা পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে খাদ্য সংকটের দিকে। আর আমাদের মতো এত জনবহুল দেশে বিপদের শংকা আরো বেশি হতে পারে। তাই এই পরিস্থিতিতে এ সংকট কাটাতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। সরকারকে বিশেষ করে ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের হাতে কমমূল্যে ডিজেল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে মানুষের খাদ্যের সংস্থানের দিকে নজর দেওয়া সবচেয়ে জরুরি। এই বাস্তবতায় কৃষকদের আগে বাঁচিয়ে রাখা আবশ্যক। দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত তাই এ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকরা যেন নিরুৎসাহিত না হয় সে বিষয়ে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে।

জিডিপিতে কৃষির অবস্থান দিনদিন কমে এসেছে। গত এক দশকে কমেছে ৫ ভাগ। কমে আসার পরও দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির প্রধান হাতিয়ার এখনও কৃষি। মোট জনশক্তির ২৪.৬৯ ভাগ এখনও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। বিবিএস (২০২০-২১) এর হিসাব অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.২৯ ভাগ। সুতরাং এই কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে বাঁচাতে হবে কৃষকদের এবং এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা এবং সঠিক নীতি প্রনয়ন করতে হবে সরকারকে। যদিও সরকার প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এত সব ব্যবস্থার পরও কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক তার অন্যতম কারন হচ্ছে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারা। তাই আগামীতে যে দুর্ভিক্ষের শংকা তৈরি হচ্ছে তা রক্ষা পেতে হলে কৃষির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাগ্রে।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।