রিয়াজুল রিয়াজ


ফরিদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোঃ ফারুক হোসেন আনারস প্রতীক নিয়ে হেরেছেন। শেখ হাসিনা মনোনীত এই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মাঠে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রায় সবগুলো অঙ্গ, সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠন। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক ও সাধারণ সম্পাদক শাহ মোঃ ইশতিয়াক আরিফ, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি একে আজাদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী পরিষদের সদস্য বিপুল ঘোষ এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানসহ অনেক নেতা-কর্মী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। নির্বাচনের আগ মুহুর্তে ফরিদপুর ঘুরে গেছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী প্রতিনিধি এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, কৃষিবিদ বাহাউদ্দীন নাসিম এমপি'র মতো কেন্দ্রীয় নেতারা। 

সবার সাথে কথা বলে গেছেন, নিয়ে গেছেন ভোটের হিসেব নিকেশ। মোঃ ফারুক হোসেনকে বিজয়ী করতে ফরিদপুর জেলার আওয়ামী সংগঠনগুলো সময়োপযোগী সব সাংগঠনিক পদক্ষেপ ই নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমান তাঁর নিজ এলাকা বোয়ালমারী, মধুখালী, আলফাডাঙ্গার দায়িত্ব নিজে নিয়েছিলেন। ওই তিন থানা নিয়ে মাথা ঘামাননি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ। অবশ্য আওয়ামী লীগ শেষ মুহুর্তে হলেও ওইখানে ভিজিট করে ভোটারদের সাথে কথা বলেছিলেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুর রহমানের দিক নির্দেশনা মেনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে আসছিলেন। প্রচারণার শুরুতে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে একটা শক্তিশালী নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা কমিটি করা হয়েছিল কিন্তু যে যার মতো পৃথক পৃথক গ্রুপে ভাগ হয়ে মোঃ ফারুক হোসেনের জন্য কাজ করায় ওই কমিটি সঠিকভাবে, পরিপূর্ণ পরিকল্পনা ও সমন্বয় করে কাজ করতে পারেনি। মোঃ ফারুক হোসেনের নির্বাচন পরিচালনা হতো একাধিক স্থান থেকে একাধিক গ্রুপের মাধ্যমে। প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে একগ্রুপ, আওয়ামী লীগ নেতা একে আজাদ বাস ভবন থেকে এক গ্রুপ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা বিপুল ঘোষের বাস ভবন থেকে এক গ্রুপ, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এর এক গ্রুপ এবং সর্বোপরি আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোঃ ফারুক হোসেনের বাসা থেকেও নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা হতো।

মুলতঃ উল্লেখিত সবাই ই মাঝে মাঝে সম্মিলিতভাবে, আবার মাঝে মাঝে পৃথক পৃথক দলে ভাগ হয়ে যার যার অবস্থান থেকে শেখ হাসিনার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করে গেছেন। নির্বাচনী প্রচারণা কাজে কিছুটা প্লান থাকলেও একক কোন নেতৃত্বে মোঃ ফারুক হোসেনের প্রচারণার কাজ পরিচালনা হয়নি। ছিল কাজের সমন্বয়হীনতা ও বিজয়ের ব্যাপারে অভার কনফিডেন্টের। থানা ভিত্তিক ভোটের হিসাব নিকাশ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলেও মনে হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দেয়া থানা ভিত্তিক ভোটের অংক ফরিদপুর সদর ও চরভদ্রাসন থানার ক্ষেত্রে কিছুটা মিললেও কোন কোন থানার ক্ষেত্রে তা আশাহতই শুধু করেনি, বরং বড় পার্থক্যও গড়ে দিয়েছে! নগরকান্দা ও সালথা থানার ভোটের হিসেব তো পুরাই উল্টো হয়েছে। তাছাড়া মধুখালি, আলফান্সো ও বোয়ালমারী এই তিন থানা থেকে ৩০০ ভোট আনারসে আসবে বলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমান দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করলেও দুঃখজনকভাবে, সেখানেও ৬২ ভোট কম এসেছে। সালথা ও নগরকান্দা এই দুই থানায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর আনারস প্রতীক ২০০ ভোটের কাছাকাছি পাবে বলে হিসেব করলেও, সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ওখানেই মোঃ ফারুক হোসেন খেয়েছেন। মোঃ ফারুক হোসেনের আনারস মার্কার পক্ষে সালথা-নগরকান্দা মোট ভোট পড়েছে মাত্র ৭৮টি! পক্ষান্তরে, এই দুই থানায় স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছেন তাঁর দ্বিগুণেরও বেশি। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে, সদ্য প্রয়াত সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর এই আসনটিতেই মুলতঃ হেরে গেছেন ফরিদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোঃ ফারুক হোসেন।

কেন সালথা-নগরকান্দার ভোট হিসেবে এতো গরমিল হলো, সেটা নিয়েও চলছে নানাবিধ বিতর্ক। বিএনপি'র ভোটগুলো কে পেয়েছেন? সালথা ও নগরকান্দায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর দায়িত্বে কারা ছিলেন? কারা ওই দুই থানায় ভোটের কল কাঠি নাড়িয়েছেন? ফরিদপুর সদরের থেকে কেমনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৬ ভোট পায়? কারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, কেন করেছেন? এসব হিসেব-নিকেশ এখন কে মিলাবেন??

হারের প্রকৃত কারণ নিখুঁত ভাবে নির্নয় করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে, অতি মাত্রায় দলীয় গ্রুপিং, প্রকাশ্যে -অপ্রকাশ্যে বিরোধিতা, শৃঙ্খলাহীনতা, নির্বাচনী প্রচারণার কাজে সমন্বয়হীনতা, একাধিক নেতৃত্ব, হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের বিরোধিতা, বিদ্রোহী নেতা-কর্মীর অস্বস্তিকর কৃত-কর্ম, বিরোধী দলগুলোর ভোটের হিসেব-নিকেশ, ভোটারদের ভোট বিক্রি ইত্যাদি অনেক কিছুই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোঃ ফারুক হোসেনের পরাজয়ের কারণ হতেই পারে! কিন্তু অন্য কোন ষড়যন্ত্র এর মধ্যে জড়িত আছে কিনা তাও তদন্তদের দাবী রাখে। দৃশ্যত যারাই আনারসের জন্য কাজ করেছেন, সবাই মোঃ ফারুক হোসেনকে বিজয়ী করার লক্ষ্য নিয়েই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছেন।

ফরিদপুরের মাটিতে শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থী'র হার মানেই জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীর হার।
এই পরাজয়ে ফরিদপুরে কার কার লাভ হয়েছে কার কার ক্ষতি হয়েছে সেসব না খুঁজে, শেখ হাসিনা ইস্যূতে আওয়ামী লীগ কতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছেন সেটা খুঁজুন। কারণ ফরিদপুরের মাটিতে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারে, এইটা বিশ্বাস করি না। এই পরাজয়ে ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের গায়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হলো তা এতো সহজে ঠিক হবে কি?

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।