আবীর আহাদ


সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা ডিজিটাল সনদ ও স্মার্ট আইডি কার্ড বিতরণকর্ম প্রায় শেষপর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। এর বিশেষত: এই যে, প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি অনেক রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও স্মার্ট আইডি কার্ড লাভ করছে! এ দু:খজনক ঘটনায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত ও ব্যথিত হলেও, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মহলে দারণ আনন্দ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে! তারা এসব পেয়ে ভীষণ পুলকিত এ জন্য যে, তারা ভুয়া হলেও তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে চিরদিনের মতো 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' খেতাবে ভূষিত হলো। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও সরকারি নানান সুযোগ সুবিধা বংশপরম্পরায় পেয়ে যাবে! অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার হলেও তারা একলাফে সমাজের বুকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে গেলো! তাইতো এভাবে বলা যায়, আসল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সর্বনাশ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বিজয়োল্লাস!

একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই যে, একমাত্র প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ ছাড়া দেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, জাসদ-বাসদ প্রভৃতি দলসহ বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ আইনজীবী সাংবাদিক বিভিন্ন পেশাজীবীমহল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে একেবারেই নীরবতা পালন করছেন! এ নীরবতার কারণও বিদ্যমান। অতীতে বিএনপি-জামায়াত ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শাসন আমলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় সব মিলিয়ে আনুমানিক যে ৭০/৮০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা স্থান পেয়েছে, তার মধ্যে এসব মহলের অনেকেরই নাম রয়েছে! ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এত বড়ো জালিয়াতি সংঘটিত হলেও তারা কেউ টু-শব্দটি করছেন না! দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অন্যান্য মহল যখন এ বিষয়ে নিশ্চুপ, তখন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যরা অর্থের বিনিময়ে যখন তখন যে কাউকে আজান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছে! বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার কেনো যে "ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রকল্প''টি প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে যখন এতো তোড়জোড়, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যখন অনেকের মনে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অদম্য খায়েশ, তখন সঙ্গত কারণ আমাদেরকে "কারা মুক্তিযোদ্ধা" এ সংজ্ঞার মধ্যে আত্মানুসন্ধান করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা কারা- এ-সম্পর্কিত একটি সংজ্ঞা স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক ১৯৭২ সনের আগস্ট মাসে এক গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছিলো। সেই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় বলা হয়েছিলো: "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি যেকোনো সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর (ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন।" এ সংজ্ঞাটিই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা। সেই সংজ্ঞাটি কোনো সরকার বাতিল করেছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মম তিরোধানের পর অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার, এমনকি চলমান আওয়ামী লীগ সরকারও নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের নামে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার এক জঘন্যতম প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার রাজাকার-আলবদররাও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে!

বঙ্গবন্ধু সরকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষের উর্দ্ধে নয়। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাত দিয়ে সেই সংখ্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষের অনেক ওপরে। এর মধ্যে ৭০/৮০ হাজারই ভুয়া। এখনো বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞার বাইরে গোঁজামিল দিয়ে প্রায় প্রতিনিয়ত মুক্তিযোদ্ধা জন্ম দেয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে এমনই ভুত ঢুকুছে যে, সেই ভুতের আছরে চার/আট/দশ বছরের শিশুও মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে! আর এখন চলছে সেসব অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের জয়োল্লাস, যারা জামুকা তথা সরকারের অনুমোদনক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিগণিত হলো! দেশের সর্বত্রই যখন দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসব চলছে, তা থেকে জাতীয় গর্ব ও শৌর্যের স্থান "মুক্তিযুদ্ধ"কে বিতর্কিত ও অবমূল্যায়ন না করলে যে মহলবিশেষের স্বস্তি থাকে না! অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার একটি জঘন্য অপরাধ। কোনো অপরাধই কখনো পার পেয়ে যায় না। আজ হোক, কাল হোক সে অপরাধের শাস্তি হবেই হবে।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।