মঈনুল ইসলাম রাকীব : একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট সেই রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষিত করে তোলা । এই প্রক্রিয়ায় একটি ছেলে বা মেয়ে যে বিষয়ে পড়তে আগ্রহী তাকে সে বিষয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এর কোন অবকাশ নেই। স্বাধীনতার পর বেশ কিছু বছর শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল, তবে পরে তা ক্ষুন্ন করা হয় নানা পদ্ধতির নামে ভুল বা অপপদ্ধতিতে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেছেন। এর প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার নিয়মে একটিবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাবি ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী। এই ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটু আলোচনা হওয়া এখন সময়ের দাবি ।

১।
একটি ছেলে বা মেয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত একেবারেই কচি থাকে। সে বোঝেনা কিভাবে তাঁর জীবন গড়তে হবে। এই সময় তাঁকে শিক্ষা দেওয়া হয় ভাষা, ব্যবহার, বিভিন্ন বিষয়ের প্রাথমিক ধারনা, খেলাধুলা, সামাজীকিকরণ, নিজের ও মানুষের পরিচয় এবং নৈতিক শিক্ষা প্রভৃতি এবং এই সবকটি শিক্ষা দেওয়া হয় আনন্দমূলক উপায়ে। তারমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের উপর চাপ না দিয়ে পড়াশোনা শেখানো হয়। আরো সহজ করে বললে “ প্রতিযোগিতা ” নয়, “ সহযোগিতা ” হয় শিশুদের শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধুতি।
আর বাংলাদেশে এই বাচ্চা ও কোমলমতি শিশুদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই একটি পাবলিক পরীক্ষার সম্মুক্ষিণ করে দেওয়া হয়। ফলে এই সময়েই একটি বাচ্চা অবমূল্যায়নের মাধ্যমে “ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ” ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়। ফলে একটি বড় অংশ তার মেধার বিকাশের আগেই কথিত সিস্টেমের আলোকে কম মেধাবী বা বেশি মেধাবী হিসেবে পরিচিত হয় যা শিশুর মানসিক বিকাশে প্রচন্ড এক ধাক্কা। একটি শিশু ভাবার এই সুযোগ পায় যে আরেকটি শিশুর চেয়ে সে উত্তম অথবা অধমÑ মনস্তাত্ত্বিকভাবে যা একটি শিশুকে বৈষম্য ও অসমতার স্বচ্ছ ধারনা দেয়। এরপরে ফেইল করে ঝরে পড়ার কথা নাই বললাম।এ এক করুণ কাহিনী, ভবিষ্যত নষ্ট হওয়ার ভয়াবহ খেলা !

২।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থ্য় অষ্টম শ্রেণীতে এসে আরো একটি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এই পরীক্ষার সময় একটি শিশু বয়:সন্ধিক্ষণের কাছাকাছি বা সন্ধিক্ষণেই থাকে। এসময় প্রতিটি শিশু থাকে নিজস্ব জগৎ নিয়ে। অভিভাবককে তাই শিশুকে দিতে হয় প্রচুর সময়। মানুষ ও জীবন সম্পর্কে সে হয়ে ওঠে কেীতূহলী। তার সংবেদনশীল হৃদয়কে যথাসম্ভব আনন্দ ও চাপহীন সচেতনতা দিয়ে গড়ে তুলতে হয়। অথচ এই সময়ে সে কিভাবে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে সেই চিন্তায় থাকে। কোচিং, প্রাইভেট এরও কদর বেড়ে যায়্ । ফলে শিক্ষা ও জানার চেয়ে সনদপত্রে জিপিএর পরিমাণ হয়ে যায় মূখ্য। এটি সৃজনশীলতা হতে পারেনা, এটি সৃজনঅশীলতা-অপ্রিয় হলেও সত্য।

এখানে দ্বিতীয় ধাপে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য ও অসমতার ধারনা জন্ম নেয়। একটি শিশু তার প্রাপ্ত জিপিএ দ্বারা মূল্যায়িত হয়। কম জিপিএধারীর বাবা মা মিষ্টি কিনে আনেনা, তবে বেশি জিপিএ প্রাপ্ত শিশুর বাবা মা আনে। ফলে যে শিশুটি কম পেল তার ধারণা জন্মে সে কম মেধাবী এবং তার দ্বারা এর চেয়ে ভালো কিছু অসম্ভব। অথচ প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি শিশুই সমান মেধাবী এবং সঠিক পরিচর্যায় প্রতিটি শিশুই হতে পারে সমান যোগ্য ও সৃষ্টিশীল।
৩।
কথিত জেএসসির সনদপত্রে প্রাপ্ত নম্বরটি আমাদের দেশের সিস্টেমে নির্লজ্জের মত বলে দেয় একটি শিশুর মেধা, দক্ষতা এবং জ্ঞান ধারণ ক্ষমতা। এর উপর ভিত্তি করে অভিভাবক ও শিক্ষকরো একটি শিশুকে বিজ্ঞান, মানবিক অথবা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ার সুযোগ দেন যেটা একটি সরাসরি অবিচার ঐ শিশুর উপর। দেখা যায় একটি শিশু আঁকছে ভালো, গল্প বলতে পারে ভাল, দারুনভাবে লিখতে পারে যেকোন রচনা-ভালো জিপিএ তাকে নিয়ে যায় বিজ্ঞান অথবা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে। আরেকটি শিশুর যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে, খেলনা মেরামত করতে ভালো লাগে-তারপরেও কম জিপিএ প্রাপ্তি তাকে নিয়ে যাচ্ছে মানবিক বিভাগে। এটা মেনে নেয়া যায়না। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা এখন পর্যন্ত এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতি তৈরি করতে পারেননি যেখানে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞানকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারবে একটি শিশু, তার অভিভাবক, শিক্ষক এবং পারিপার্শ্ব। এক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমও দায় এড়াতে পারেনা।

এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা খুবই ভয়ের কথা এবং এই ভয়ঙ্কর কথাটি দানবের মত বড় হয়ে উঠছে দিনদিন। একটি শিশু নবম শ্রেণী থেকে এই সমাজে হয় বিজ্ঞানের, না হয় ব্যবসায় শিক্ষার অথবা মানবিক বিভাগের স্থায়ি বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। লজ্জার কথা আমাদের দেশের পদ্ধতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে বেশি মেধাবী, ব্যবসায় শিক্ষাকে তারচেয়ে কম মেধাবী এবং মানবিককে একেবারে খাতায় না গুনেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং বছরের পর বছর ধরে আমরা তা দেখে যাচ্ছি। অথচ প্রকৃতপক্ষে এ্ই তিন বিভাগের শিক্ষার্থীই সমান মেধাবী এবং ক্ষেত্রবিশেষ পরিশ্রমের ক্ষেত্রে একে অপরের চেয়ে এগিয়ে, সেটা কখনোই সামগ্রিক ফল নয়। কিন্তু আমাদের ঘূণধরা পদ্ধতি বলে ৯০ % ক্ষেত্রে নবম শ্রেণীর জিপিএ ভালোধারীরা বিজ্ঞান বিভাগ নেয়। কিন্তু কেন ? দেশের শিক্ষাপদ্ধতি কেন মানবিককে সমানগুরুত্ত্ব দিয়ে প্রচার করতে পারছেনা ? কেন দেশের নীতিনির্ধারকেরা তিনটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যই সমান কর্মসংস্থাপনের ব্যবস্থা করতে পারছেননা বা করছেননা ?

আর উন্মুক্ত বা কারিগরি ব্যবস্থায় যারা পড়াশোনা করছে তাদের যেীক্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের কার্পণ্যকে এই সমাজ এই রাষ্ট্র কতটুকু বিবেচনায় রাখছে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কেন আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বছরের পর বছর ফেলে রাখছি?
৪।
যা হোক জেএসসি ও এসএসসির পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা আসে। এখানে দুই বছর কেটে যায় শিক্ষার্থীর বুঝে উঠতে না উঠতেই। প্রথম বছরের অর্ধেক কেটে যায় ফলাফল প্রাপ্তির অপেক্ষা, ছুটি ও বিনোদনে। তারপর হঠাৎ পড়ে যায় প্রথম বছরের বার্ষিক পরীক্ষার তারিখ। ছেলেটি অথবা মেয়েটি শুরু করে প্রাণপন পড়াশোনা। অথবা কেউ কেউ পড়েইনা। কিন্তু কেন? একটু পরে বলছি কেন পড়েনা।
প্রথম বছরের পর দ্বিতীয় বছরের ক্লাস শুরু হয়। আবার পড়া শুরু করে। এবছর সম্পূর্ণ নতুন বই। তারপর কিছুদিন পর পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বছরের সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত। আমি বুঝিনা এটি কেন করা হয় ? সমমানের সারা পৃথিবীর অন্যকোন পরীক্ষায় এতবড় সিলেবাস থাকে কি না সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। যাহোক এর ফলে প্রথম বছরের সব বই আবার পড়তে হয়। এই বই আবার পড়তে হবে বলেই প্রথম বছরে কেউ কেউ ফেলে রাখে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন প্রথম বছরের পরীক্ষার সিলেবাস দেওয়া হচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ? ৯-১০ শ্রেণীর সিলেবাসটি ছোট হলেও উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের পাঠ্যসূচি অনেক বিস্তৃত।

এই সময় প্রতিটি শিক্ষার্থী আবার সেই জিপিএর জন্য পড়ে। উদ্দেশ্য কথিত “ স্কোর বাড়ানো ”। কিন্তু কেন ?

৫।
উচ্চমাধ্যমিকের ফল ঘোষণার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন বোনা। শুরু হয় কোচিং করা। এই কোচিংয়ের ব্যাপারে অনেকে অকারণে নাক সিঁটকায় অথচ এরা সত্যিই অনেক আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদেও পড়ায় যদিও এই কোচিংয়ে না পড়ে শিক্ষার্থীরা সুযোগ অবশ্যই পেতে পারে। তবে এখানে ভর্তি পরীক্ষার জন্য এক অদ্ভুত শর্ত বেধে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো। তারা একটি ন্যূনতম জিপিএকে শর্ত হিসেবে আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। এতেই ক্ষ্রান্ত না দিয়ে তারা একটি বাছাই পরীক্ষাও নেয়। এর ফলে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ পায়, বাদ পড়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র। আবার শর্তের বেড়াজালে আটকে পড়ে বিশাল অংশের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগই হয়না। এখন কথা হচ্ছে এই পদ্ধতি কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য ? এর একটাই উত্তর আছে-“ না, কিছুতেই না ”।

প্রথমেই বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মেীলিক অধিকার, এটি কোন সুযোগ বা দাবি নয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকের শিক্ষার চাহিদা পূরণ করবে এবং নাগরিক শিক্ষিত হয়ে পরবর্তি সময়ে রাষ্ট্রকে সেবা দেবে-এটি একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের মূলনীতি। যদি রাষ্ট্রটি কল্যাণ না হয় তাও শিক্ষাকে মেীলিক চাহিদা হিসেব প্রতিটি নাগরিকের কাছে পেীঁছে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ত্ব। তাহলে কেন একটি ছেলে বা মেয়ে বা উভলিঙ্গ মানুষ উচ্চমাধ্যমিকে কৃতকার্য হয়ে তার পছন্দমত বিষয়ে পড়তে পারবেনা? কেন তাঁকে বাঁধা ডিঙাতে হবে আবারো?

যদি পদ্ধতির প্রতি আস্থা রেখে মেনেই নিই ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি “ যৌক্তিক ” তবে বলবো কেন শর্ত আরো করা হবে সেটার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। একটি ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে যে ফল করে তার অবশ্যই পরিবর্তন হতে পারে ভর্তি পরীক্ষায়। আর জিপিএ যে এই সমাজের ধারাবাহিক একটি ভুল মেধা মনোনয়ন পদ্ধতি সেটা ১-৪ এ আগেই বলে এসেছি। কেন একজন নাগরিকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নষ্ট করা হবে চারবছর আগের মাধ্যমিক পরীক্ষার জিপিএ দিয়ে ? সে যদি ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ায় “ অযোগ্য ” হয় তবে তাকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে অযোগ্য প্রমাণ করা হোক। এমন উদাহরণ লক্ষ লক্ষ দেওয়া যাবে যে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে ফলাফল খারাপ, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয় ভালো ফলাফল করেছে- সেটি ভর্তি পরীক্ষা এবং ভর্তি পরবর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরীক্ষায়। তাহলে কেন এই সমাজ বা পদ্ধতি একটি ছেলে বা মেয়েকে তাঁর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছেনা ? একটি ছেলেকে কেন আজীবন এই মিথ্যা অভিযোগে ভুগতে হবে যে “ সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, এমনকি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্যও অযোগ্য ” ? অথচ উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পার করে এসেই সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যোগ্যতার যেীক্তিক প্রমাণ দিয়ে এসেছে। উপযক্ত পরিবেশ ও সুযোগ পেলে অবশ্যেই তার জিপিএ অন্যদের চেয়ে কম হতোনা

দ্বিতীয় এবং অযেীক্তিক শর্ত হচ্ছে মাত্র একবার, অথবা দুই বার ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। এটি এমন একটি বাঁধা যা শত শত ভবিষ্যৎ ফুলকে অকালে ঝরিয়ে দেয়। এই নিয়ম যে বা যারা করেছে তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন ঠিক কি যুক্তির ভিত্তিতে একটি ছেলেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে আপনি বা আপনারা বঞ্চিত করলেন ? কেউ যদি চায় সে বুড়ো বয়স পর্যন্ত একটি বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যাবে তাতে আমার আর আপনার কি সমস্যা ? বলতে পারেন কোন যেীক্তিক কথা কেন মাত্র একবারই পরীক্ষা দিবে কেউ ? কেন সে বারবার দিতে পারবেনা ? এই সুযোগ তো সবার জন্যই। প্রথমত আপনি একজনের মেীলিক অধিকার না পূরণ করে সেখানে একটি অসম প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছেন। এটি মেনে নেওয়া যায়না-তবে মেনে নিতে হয়েছে আমরা এতোই দুর্ভাগা।
তবে এখানে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া উচিত। সম্প্রতি আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন সেটি সম্পূর্ণ অযেীক্তিক। শিক্ষামন্ত্রীর উচিত শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া। শুধুমাত্র ভুরি ভুরি পাশ বা জিপিএ ৫ প্রাপ্তি শিক্ষার মানকে প্রকাশ করেনা। শিক্ষার মান প্রকাশের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমাণটা একটি মাধ্যম। অতএব শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে আরো সচেতন হোন। অন্যথায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সময়ে পাওয়া এ প্লাসধারীদেও ব্যর্থতাটা কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করুন অনুগ্রহ করে।

একইভাবে একবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখার নিয়ম করে ঢাবি কর্তপক্ষও একধরনের অবিচার করতে যাচ্ছে। একজন নাগরিকের উচ্চ শিক্ষা পাওয়া তার মেীলিক অধিকার, এটা কখনো সুযোগ নয়। আমাদের রাষ্ট্রের অনেকেই এই নির্মম ও ধ্রুব সত্যটি ভুলে যেতে বসেছে যা জাতি হিসেবে আমাদের নিচের দিকে ধাবিত করতে কাজ করছে। সম্ভবত ঢাবির পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে এই নিয়ম করতে চলেছে ঢাবি কর্তপক্ষ যেটা আরো ভেবে দেখার সময় আছে। একটি শিক্ষার্থীকে একেতো তার অধিকার পূর্ণভাবে দেওয়া হচ্ছেনা, তার ওপর যদি তার সুযোগকেও সীমাবদ্ধ করা হয় তবে সেটি শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং একই সঙ্গে জাতীয় উন্নতির পথে অন্তরায় হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে।

সবশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা এই পৃখিবীর সকল শিশুই জন্মের সময় সমান মেধা ও মনন নিয়ে আসে। তারপর আমাদের বানানো সমাজ, আমাদের রীতিনীতি, পদ্ধতি ও অপপদ্ধতি এইসব শিশুদের মধ্যে মেধার শ্রেণী তৈরি করে, সহযোগিতার মানসিকতাকে পিছে ফেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধ্বংসাত্মক মানসিকতার জন্ম দেয়। এই দ্বন্দ্ব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করে । ফলে জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়ে। সহকর্মীর প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ এবং সর্বক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিস্বত্তার উদ্ভব ঘটায়। এরফলে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রসরতা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়া অংশ সমাজে বেকার, সন্ত্রাসী, নেশাগ্রস্থ ও ভবঘুরে হিসেবে বিরাজ করে। ভুল ও যুগানুপোযোগী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে অনিশ্চৎ এক হতাশাগ্রস্ত প্রজন্মের সংখ্যাধিক্য হয় তাঁরা দেশ ও জাতির উন্নয়নের তরীকে গুন দিয়ে পিছনের দিকে টেনে নিতে অনিচ্ছায় নিয়োজিত হয়।

শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অবাধে পড়ার সুযোগের জন্য কল্যাণমূলক পরিবর্তন আসবে এই প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশার পরিমাণ বেড়ে যায় যখন স্বপ্ন দেখি দেশের প্রতিটি নাগরিক বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের বারান্দায় পা দিচ্ছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রথম ধাপ হোক দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংষ্কার, জাতীয় অগ্রগতির পথে শিক্ষা হোক প্রধান বাহন।

লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষার্থী, জাবি

(এএস/অক্টোবর ১৫, ২০১৪)