প্রবীর বিকাশ সরকার : যার কোনো সাইনবোর্ড নেই সেই চিরচেনা ‘দাদার দোকান’ বা ‘বিনোদদা’র চা স্টল’ চেনেন না এমন কোনো সাহিত্যকর্মী, সংস্কৃতিকমী এবং রাজনীতিকর্মী এই কুমিল্লা শহরে আছেন বলে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। থাকলে তাকে কুমিল্লার শহরবাসী বলা যাবে কিনা জানি না। দেশ-বিদেশের বরেণ্য, খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিক যে কত এই দোকানে এসেছেন বা এখনো পা রাখেন সেই ইতিহাস একমাত্র দাদাই জানবেন।

দাদার সম্পূর্ণ নাম বিনোদ বিহারী দে। এখন তার বয়স ৭৬ বছর। এই শহরের আদি অধিবাসী দাদার বাবা কামিনীকুমার দে ১৯২৮ সালে এই চায়ের ছোট্ট দোকানটি চালু করেছিলেন। তার জন্মস্থান কুমিল্লার প্রসিদ্ধ মহল্লা বাদুরতলা---এর সংলগ্ন স্থানেই ভাষাশহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিত্যক্ত বাড়িটি বিধ্বস্ত----ধুলিস্মাৎ হওয়ার জন্য সকরুণ প্রতীক্ষমাণ।

সেই সময় বৃটিশ যুগ, জানি না পরিকল্পিত সেই কুমিল্লা শহরে কতগুলো চায়ের স্টল বিদ্যমান ছিল। এও জানি না ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কৌতূহলবশত কোনোদিন কামিনীকুমার দে’র চায়ের দোকানে এক কাপ ধূমায়িত চায়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন কিনা। কিংবা যিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রথম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে এই শহরের অহঙ্কার স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ এডভোকেট আহাম্মদ আলী তিনিও কি দুদন্ড বসেননি দাদার দোকানে ভাবাই যায় না! সেই সময় দোকানটি যে জমজমাট ছিল তা বলাই বাহুল্য। কারণ কলেজ স্ট্রিটের দোকান বলে কথা। শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীরা এখানে সকাল-বিকেল নিশ্চয়ই ঢু মেরেছেন। অবশ্য পরবর্তীকালে এর নাকের সামনেই রাস্তার ওপারে নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় সিনেমা হল ‘লির্বাটি’ যা বহুবছর ধরে পরিত্যক্ত ও মামলার শিকার। সুতরাং সহজেই বোধগম্য যে কী রমরমা ছিল দাদার দোকানটি! কৈশোরেই তো আমি প্রত্যক্ষ করেছি এর কর্মচঞ্চল রূপ।

অবশ্য পাশাপাশি আরও একটি-দুটি রেস্টুরেন্ট ছিল দুদশক আগেই উঠে গেছে। যেমন উঠে গেছে পাশেরই অতিপরিচিত কালুদার চা স্টল, মুছে গেছে কান্দিরপাড়ের জনপ্রিয় ‘সুইট হোম’ চায়ের দোকানটি। কুমিল্লা শহরের প্রথম চায়ের স্টল কি ‘লক্ষ্মী কেবিন’ যেটা নজরুল এভিনিউতে ছিল মালিক ছিলেন দুভাই, যেখানে আড্ডা দিতেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সঙ্গীতকার যেমন অজয় ভট্টাচার্য, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অজিত দত্ত, শচীন দেববর্মণ প্রমুখ। কবি বুদ্ধদেব বসু কিংবা কাজী নজরুল ইসলামও যে সেখানে ঢু মারেননি কে বলবে? (সাহিত্য সাময়িকী ‘পূবর্বাশা’ ও এর সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং ইতিহাসখ্যাত ‘সিংহ প্রেস’ নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিকে’ প্রকাশিত হয়েছিল সেটাতে লক্ষ্মী কেবিনের প্রসঙ্গ আছে।)

বিগত ৮৫ বছরের ইতিহাসে স্বনামধন্য ভিক্টোরিয়া কলেজের সম্মুখে অবস্থিত এই এক চিলতে দোকানটি যাকে বলা যেতে পারে স্মৃতিকাতর বৃটিশ ইংলিশে ‘কলেজ ক্যান্টিন’ এর ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে। রাজনৈতিক দাঙ্গাতো সুদূর অতীতের মতো এখনো লাগাতার বিদ্যমান, একাত্তরের সময় লন্ডভন্ড অবস্থা, তাছাড়া হিন্দুর দোকান আত্মসাৎ করার মতলববাজদের অহর্নিশ ষড়যন্ত্র তো ছিলই, এখনো আছে। সবকিছুর লেলিহান আগুনকে প্রতিহত করে দাদা মূল্যবান পিতৃস্মৃতিকে রক্ষা করে যাচ্ছেন জীবন সায়াহ্নে এসে। পুত্র (পাশে দন্ডায়মান) মানসিকভাবে কিছুটা স্লথ তাকে সাহায্য করছেন।

সর্বদা হাসিমুখ বিনোদদা কত জ্বালা আর অত্যাচার আমাদের সয়েছেন তার হিসেব নেই। এখনো কি কম? কত টাকা বাকি আছে বা চিরতরের জন্য পাননি বা পাবেন না বলে নির্ধারিত হয়ে গেছে তারও কোনো হিসেব নেই। দাদার কোনো শত্রু আছে বলে কখনো শুনিনি। এই বয়সে এখনো যে মানুষের সেবা করে চলেছেন নিরলসভাবে এটাই তো আমাদের জন্য পরম পাওয়া। এক-একজন প্রবীণ শুভাকাঙ্খী আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন এক-একটা মূল্যবান অজ্ঞাত ইতিহাস। বিনোদদার সঙ্গে কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে একদিন শোনার ইচ্ছে নিরিবিলি বসে। দাদা যদি মুখ খোলেন তাহলে সাংঘাতিক কত ঘটনাই না জানা যাবে!

বিনোদদা’র হাতের তৈরি চা ও লুচি খেয়েছি আমরা কত শত জন কিন্তু তার সেই নির্ভেজাল সেবার বিনিময়ে আমরা কি তাকে একদিন একটা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনুষ্ঠানিক ‘প্রণতি’ জানাতে পারি না? নিদেনপক্ষে একটা সংবর্ধনা? বাঙালি বড় কাঙাল জাতি, বাঙালি বড় অকৃতজ্ঞ-কৃপণ----ইতিহাসেই আছে।

যৌবনের প্রায় ৩০ বছর প্রবাসী। কিন্তু দেশে এলেই দাদার দোকানে ঢু না দিলে পুরনো সেই নড়বড়ে টেবিলের জলপচা গন্ধটাকে ভুলে যেতে হবে যে! বিনোদদা বয়স তুলেছেন জীবনে প্রচুর দোকানটিও তাই, নতুন শুধু একটি ফ্রিজ আর স্টিল-কাচের শোকেস জায়গা নিয়েছে। আগে ছিল কাঠ-কাচের তৈরি একটি নিরাভরণ শোকেস। প্রিয় শহরে সেইসব জাগরী দিনরাত্রি চলে গিয়েছে আমাদের---এখন স্মৃতির চুলে সাদা রঙের সাম্রাজ্য বিস্তৃতমাণ। তবু আজও কানে এসে বাজে বিবস্ত্র বিদগ্ধ দুপুরের রাস্তায় বাল্যবন্ধুর তরুণ চিৎকার: বিকেলে দাদার দোকানে আসিস দেখা হবে........!
লেখক : জাপানপ্রবাসী
(এএস/অক্টোবর ১৫, ২০১৪)