মিঠুন গোস্বামী, রাজবাড়ী : সংরক্ষণের অভাব আর দখলদারদের কারণে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য বহনকারী শত শত বছরের রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির নলিয়া গ্রামের জোড় বাংলা মন্দির। এক সময় জোড় বাংলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে অপরূপ সাজে সেজেছিল একে একে ৫০টির অধিক মন্দির। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সেখান থেকে বেশিরভাগ মন্দির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি ৩টি মন্দির এখন সংরক্ষণের অভাবে হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যে তিনটি মন্দির রয়েছে সেগুলোতেও প্রশাসনের কোন নজরদারি নেই। মন্দিরগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩ শত বছর আগে ১৬৫৫ সালে রাজা সীতা রাম রায় বর্তমান রাজবাড়ীর বেল গাছিতে তার ইচ্ছা অনুসারে একটি সোনার মূর্তি দিয়ে দুর্গা পূজা করতে চেয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে মন্দিরের মূর্তি তৈরি করার জন্য নলিয়া গ্রামের এক কর্মকারকে মূর্তি বানানোর নির্দেশ প্রদান করেন তিনি।

মূর্তি তৈরির জন্য সেই কর্মকার রাজা সীতা রাম রায়ের কাছে স্বর্ণ চেয়েছিলেন।কিন্তু ওই কর্মকার স্বর্ণ চুরি করতে পারে এমনটি ভেবে রাজা তাঁকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে মূর্তি বানাতে বলেন। রাজার এই কথায় কর্মকার মনে কষ্ট পেয়ে রাজার বাড়িতে গিয়ে সোনার মূর্তি পাশাপাশি আরেকটি পিতলের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। পূজার আগের দিন পুকুরে মূর্তি ঘষামাজার সময় রাজার নির্দেশকৃত স্বর্ণের এবং পিতলের ওই দুটি মূর্তি পরিবর্তন করে ফেলেন।যখন পূজা আরম্ভ হবে তখন সেই কর্মকার রাজার অনুমতিক্রমে সত্যটা প্রকাশ করেন।

কিন্তু ধর্মীয় রীতিতে এক মন্দিরে দুই পূজা না করার বিধি থাকায় তখন রাজা ওই কর্মকারকে পিতলের মূর্তিটি তাঁর নিজ বাড়ি নলিয়া গ্রামে স্থাপন করে সেখানে পূজা করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং মন্দিরটি রাজা নিজে স্থাপন করে দেন। সেই থেকেই সৃষ্টি হয় নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির।

এই জোড় বাংলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে ৮টি মন্দির স্থাপন করে দেন রাজা সীতা রাম রায়। অযত্ন আর অবহেলায় মন্দিরটি এখন বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘদিন কোন সংস্কার না হওয়ায় মন্দিরটি তার শত শত বছরের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী মন্দিরটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। মন্দিরটি দ্রুত সংস্কার করে শত বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার দাবি জানিয়েছেন আগত দর্শনার্থীরা।

মন্দিরের সেবায়েত বিদ্যুৎ কুমার মুখার্জি বলেন, রাজা সীতা রাম রায়ের আমলে এই মন্দিরটি স্থাপিত হয়। এখানে মন্দিরের নামে এখনো ৩১ শতাংশ জমি রয়েছে। এর বেশিরভাগ জমিই এখন বেদখল হয়ে গেছে। এই মন্দিরগুলোর বর্তমান অবস্থা খুবই শোচনীয়।দ্রুত সংস্কার করা না হলে মন্দিরগুলোর অস্তিত্ব আর থাকবে না।

মন্দিরটি তাদের জাগায় দাবি করে বাইদুল মৃধার ছেলে বলেন, কোন নকশার উপরে এই মন্দিরের অস্তিত্ব নাই। এটি কোন সরকারি জায়গা না এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। কার থেকে এই জমি ক্রয় করা জানতে চাইলে নাম বলতে পারেন নাই তিনি। পরে তিনি বলেন, এখানে প্রায় পঞ্চাশটির মতো এরকম মন্দির ছিলো।আমার ঘর করার দরকার তাই মন্দিরের ওই অংশের ইট সরিয়ে ঘরের কাজ করছি।এই মন্দিরটাও আমার জাগাতেই।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, জোড় বাংলা মন্দিরটি আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য বহন করে থাকে। সংস্কারের অভাবে এই মন্দিরটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও আশেপাশের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। আমারা শুনেছি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এটি গ্রহণ করেছে, যারা মন্দিরটি দাবি করতো তারাও তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে আজ অব্দি সেখানে কোন উন্নয়নমূল ককর্মকান্ড বা এটি সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।আমরা দাবি করি খুব দ্রুত মন্দিরটি সংস্কার করে সেবায়েতদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ মন্দিরটি তালিকাভুক্ত করায় স্থানীয় প্রশাসন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করে নাই। যেহেতু গত এক বছরেও তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই, খুব দ্রুতই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোড় বাংলা মন্দির সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(এমজি/এসপি/নভেম্বর ২৩, ২০২২)