চৌধরী আবদুল হান্নান


নব্বইয়ের দশকে আমি সোনালী ব্যাংকের একটি জেলা পর্যায়ের শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব কেবল গ্রহণ করেছি। শাখার কৃষি ঋণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একদিন কৃষি ঋণের কয়েকটি ফাইল নিয়ে এসে বললো — স্যার, এদের নামে টাকা আদায়ের মামলা করতে হবে, বিলম্ব করলে কাগজপত্র তামাদি হয়ে যাবে, আমাদের বিপদ হবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, তাদের নামে মামলা করা হবে মর্মে চিঠি দেওয়ার পর তারা ব্যাংকে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ আতংক; ব্যাংকে গেলে যদি পুলিশ দিয়ে আটকায়।

একদিন শহর থেকে একটু দূরে গাড়ি নিয়ে এক কৃষকের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। কৃষক আবদুল কুদ্দুসের প্রথমে ভয়, পরে বিস্ময়। ব্যাংকের ম্যানেজার বাড়িতে হাজির, তার কৌতুহল আর বিস্ময়ের যেন শেষ নেই। একে অপরকে বুঝতে বা বুঝাতে সময় লাগলো না, কৃষি ঋণের বকেয়া আদায়ের জন্য আমি কখনো মামলা করবো না।

কুদ্দুস একজন সচ্ছল কৃষক, ছেলেদের নিয়ে নিজেরাই কৃষি কাজ করেন, নিজের জমি চাষাবাদ করেন। বাড়িতে পুকুর আছে, গবাদি পশু আছে।

মাত্র ২ দিনের মধ্যে তার ২ ছেলের নামে কৃষি ঋণ মঞ্জুর করে (এ ঋণ মঞ্জুর করা শাখা ব্যবস্থাপকের ক্ষমতাধীন) পিতার পুরাতন ঋণ পরিশোধ করে কিছু নগদ অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরলো তারা। এভাবে কাজ করার ফলে একজন কৃষকের নামেও মামলা করতে হয়নি।

সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীতে ১২ কৃষকের কারাবাসের ঘটনায় সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তোলপাড় কিন্ত লক্ষণীয় যে বিপন্ন কৃষকের পাশে গণমাধ্যম ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি।

বিস্ময়ের সীমা থাকে না যখন দেখি ব্যাংক থেকে লক্ষ-কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় তাদের গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তাদের নামে মামলা করতেও দ্বিধা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

অথচ প্রতিদিন টেবিলে খাবার আসে যাদের ঘর্মাক্ত পরিশ্রমে তাদের সামান্য ঋণের টাকা বকেয়া থাকায় “ঋণ খেলাপি” আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের মতো অমানবিক কাজ করতে দেখা যায় কোনো কোনো ব্যাংকের। এমন অর্বাচীন ব্যাংকার দিয়ে আমরা এখন কী করিব ?

অনেক অতি উৎসাহী ব্যাংকার পুলিশের ভয় দেখিয়ে কৃষি ঋণ আদায়ের তৎপরতা চালান, পুলিশের ভয়ে তারা বাড়ি ছাড়া হবে, পালিয়ে বেড়াবে। এক সময় দুধেল গাভী বিক্রি করে, ফসলি জমি বন্ধক রেখে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করে নিস্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে দরিদ্র কৃষক আরও দরিদ্র হয়।

ব্যাপক দুর্নীতির কবলে নিপতিত বাংলাদেশে একমাত্র দুর্নীতিমুক্ত বিশাল জনগোষ্ঠী কৃষক। সহজ সরলবাংলার কৃষক জীবন জীবিকার জন্য সারা বছর সকাল সন্ধ্যা জমিতে ফসল উৎপাদনে ব্যস্ত থাকেন, শিক্ষিত শহরবাসীর জন্য খাবার জোগান দেন।

ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকগণ সচেতন ও দায়িত্ববান হলে কোনো কৃষকের নামে মামলা করার দরকার হয়না। যতটা জানি, প্রতিটি ব্যাংকের জন্য সারা বছর কৃষি খাতে বা শষ্য উৎপাদন খাতে কৃষকদের ঋণ দেওয়ার জন্য একটা আলাদা বরাদ্ধ থাকে। প্রতিটি শষ্য মৌসুমে এ ঋণ বিতরণ করা হয়ে থাকে। ব্যাংক ম্যানেজার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে অন্য একটি ফসলের বিপরীতে ঋণ সৃষ্টি করে কৃষকের পুরাতন ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ করে দিতে পারেন। কেবল প্রয়োজন কৃষকদের প্রতি আমাদের সম্মান বোধ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক জন সভায় বলতে শুনেছি — “আমরা কৃষকদের মুখে হাসি দেখতে চাই, আমাদের উচিৎ তাদের সালাম করা।”

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি ও কৃষক; সালাম করতে না পারি, তাদের প্রতি নির্মমতা একেবারেই মানায় না।

কৃষকের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে আমাদের। সরকার এখন কৃষকবান্ধব, কৃষকদের জন্য ব্যাংকারদের কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশে বর্তমানে দশ হাজারেরও বেশি শাখা নিয়ে কাজ করছে সরকারি বেসরকারি ৬৪ টির মতো ব্যাংক।

সামান্য টাকা পরিশোধ করতে অসামর্থের কারণে পূর্বাপর বিবেচনা না করে কৃষকের নামে মামলা করা আমাদের কেবল ব্যর্থতাই নয়, লজ্জারও।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।