সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : সরকারি দরপত্র ছাড়াই কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ১৯নং আব্দুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে সরকারি ছুটির দিন বিদ্যালয় থেকে গোপনে মালামাল বের করে বিক্রি করার সময় ভিডিও করে "আমরা সত্যের পথে" নামক একটি ফেসবুক পেইজে পোষ্ট করে সংবাদ প্রচার করায় মো. সবুজ মিয়া নামে এক সাংবাদিককে জবাই করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক  নিতাই চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে।

শনিবার বিকালে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত ২ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে ওই বিদ্যালয়ের দপ্তরী সৈয়দ মাহমুদুল হাসান নূরী (পাপ্পু) বিদ্যালয়ের তালা খুলে একটি স্টিলের আলমারি, ২টি লোহার বেঞ্চ ও এক বস্তা বই গোপনে বের করে অফিসের বারান্দায় এনে এক ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করা অবস্থায় মালামাল ওজন দেওয়ার সময় বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. আলমগীর খান, অভিভাবক সদস্য মো. গিয়াস উদ্দিন, বিদ্যুৎসাহী সদস্য মোছা. লেলিন জেসমিন, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারসহ এলাকাবাসী ওই দপ্তরীকে জিজ্ঞেস করেন কার অনুমতিতে এসব মালামাল গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে? প্রতি উত্তরে ওই দপ্তরী সৈয়দ মাহমুদুল হাসান নূরী (পাপ্পু) বলেন, প্রধান শিক্ষক স্যারের নির্দেশে এসব বিক্রি করা হচ্ছে। এসময় এলাকার বহু লোক উপস্থিত ছিলেন।

বিদ্যালয় খোলা হলে এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করার অপেক্ষায় থেকে দপ্তরীকে মালামাল বিদ্যালয়ের রুমে ঢুকিয়ে তালা লাগানোর নির্দেশ দেন কমিটির সদস্যবৃন্দসহ এলাকাবাসী। এ ঘটনায় ওইদিন দৈনিক জাগো প্রতিদিন এর কুলিয়ারচর প্রতিনিধি ও "আমরা সত্যের পথে" ফেসবুক পেইজ এর এডমিন তার পেইজে "কুলিয়ারচরে ১৯নং আব্দুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে স্কুলের আলমারি ও বেঞ্চ গোপনে বিক্রির সময় দপ্তরী আটক" শিরোনাম দিয়ে একটি ভিডিও পোষ্ট করেন।

পোষ্ট করা ওই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিতাই চন্দ্র দাস সাংবাদিক সবুজ মিয়াকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজসহ হুমকি দিয়ে বলেন তাকে জবাই করে হত্যা করা হবে। এতেও সে ক্ষান্ত হয়নি। ঘটনার পরদিন শনিবার দুপুরে সে বাদী হয়ে উল্টো বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নামসহ সাংবাদিক সবুজ মিয়ার নামে কুলিয়ারচর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অপর দিকে রোববার দুপুরে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. আলমগীর খান বাদী হয়ে লিখিতভাবে ওই দপ্তরী ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর বিদ্যালয় হতে মালামাল চুরির অভিযোগ করেন।

এ ব্যাপারে সাংবাদিক মো. সবুজ মিয়া বলেন, একটি সত্য ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রচার করায় প্রধান শিক্ষক নিতাই চন্দ্র দাস তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজসহ জবাই করে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধান শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে ঘটনাটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জের নিকট অভিযোগ করেছেন।

এ ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. আলমগীর খান, অভিভাবক সদস্য মো. গিয়াস উদ্দিন, বিদ্যুৎসাহী সদস্য মোছা. লেলিন জেসমিন, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস সাত্তারসহ এলাকাবাসী বলেন, গত ২ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে তারা দেখতে পান বিদ্যালয়ের দপ্তরী সৈয়দ মাহমুদুল হাসান নূরী (পাপ্পু) বিদ্যালয়ের তালা খুলে একটি স্টিলের আলমারি, ২টি লোহার বেঞ্চ ও এক বস্তা বই গোপনে বের করে অফিসের বারান্দায় এনে এক ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করছে। মালামাল ওজন দেওয়ার সময় ওই ব্যবসায়ীকে তারা বাঁধা নিষেধ দিলে ওই ব্যবসায়ী মালামাল রেখে চলে যায়। এসময় এলাকাবাসীর সামনে দপ্তরীকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে এসব মালামাল বিক্রি করা হচ্ছে।

তারা আরো বলেন, ইতোপূর্বেও প্রধান শিক্ষক নিতাই চন্দ্র দাস কমিটির কাউকে না জানিয়ে বিদ্যালয়ের কিছু জিনিসপত্র ও তিনটি বাথরুম বিক্রি করে দিয়েছে। এসব বিষয়ে এটিও সাহেবকে জানানোর পরও কোন বিচার পাননি তারা। এ বিষয়েও ঘটনার দিন সংশ্লিষ্ট এটিও সাহেবকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন ছবি তুলে রাখার জন্য। এর আগে একটি গাছও বিক্রি করে দিয়েছিলো সে।

এছাড়া ওই প্রধান শিক্ষক মাদক সেবন করায় প্রায়ই বিদ্যালয়ে এসে মাতলামি করে। তার বডি (ডোপটেস্ট) পরীক্ষা করা হলে তার শরীরে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া যাবে। তারা এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করে ওই প্রধান শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও এ বিদ্যালয় থেকে অপসারণের দাবি জানান।

এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের দপ্তরী সৈয়দ মাহমুদুল হাসান নূরী (পাপ্পু) প্রথমে বলেন, প্রধান শিক্ষক স্যার বিদ্যালয়ের কিছু পরিত্যক্ত জিনিস বিক্রি করার জন্য আমাকে বলেছেন। তাই ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী আবেদ আলীর নিকট বিক্রয়ের জন্য একটি স্টিলের আলমারি ও দুইটি বেঞ্চ ওজন দেওয়ার সময় বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সদস্যরা এসব মালামাল বিক্রি করতে বাধা দেন আমাকে। পরে এসব মালামাল বিক্রি না করে রুমের ভিতর রেখে দেই।

এ বক্তব্য দেওয়ার পরদিন আগের কথা ঘুরিয়ে ওই দপ্তরী আবার বলেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সদস্যদের হুমকি ধমকি ও মারধোরের ভয়ে প্রধান শিক্ষক স্যার মালামাল বিক্রি করতে নির্দেশ দিয়েছেন একথা বলেছি। আসলে তারাই আমাকে বলেছে বিদ্যালয়ের তালা খুলে এসব মালামাল বারান্দায় বের করার জন্য। তাদের কথামতো মালামাল বের করার পর এক সাংবাদিককে ফোন করে ডেকে বিদ্যালয়ে এনে আমাকে মেরে ও ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে এসব কথা বলিয়েছেন।

ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী আবেদ আলী বলেন, ওই দপ্তরী আগের দিন বৃহস্পতিবার আমার নিকট গিয়ে বলেন, শুক্রবার দিন ওই বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য। বিদ্যালয় থেকে কিছু মালামাল বিক্রি করা হবে। দপ্তরীর কথায় শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে মালামাল কিনতে ওই বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। মালামাল ওজন দেওয়ার সময় বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সদস্যরাসহ এলাকাবাসীর বাধার মুখে পরে মালামাল না কিনে চলে আসতে হয়েছে। ওই দপ্তরী সবার সামনে বলেছে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে আমার নিকট বিক্রি করতে এসব মালামাল বাহিরে এনেছে।

এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিতাই চন্দ্র দাসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি উচ্চ সুরে বলেন, সত্যের পথের সাংবাদিক সবুজ আমার বক্তব্য না নিয়ে তার পেইজে এ ঘটনা প্রচার করে ভাইরাল করেছে। আমার মিজাজ খারাপ হইছে। পরে তারে বকছি আমি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে আমাকে ৫-৬টি কল করেছিলো তা দেখছি আমি। সরকারই আমাদের শুক্রবার দিন ছুটি দিয়েছেন। বন্ধের দিন আমি তার কল রিসিভ করতে বাধ্য নই। এছাড়া দপ্তরীকে মালামাল বিক্রি করার নির্দেশ দেননি দাবী করে তিনি বলেন, মালামাল বিক্রি করার এখতিয়ার আমার আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি মালামাল বিক্রি করতে পারি। ওই সাংবাদিক আমার বক্তব্য না নিয়ে প্রচার করায় আমি তার নামে ও আমাকে বিদ্যালয়ে যেতে বাধা দেওয়াসহ দপ্তরীকে মারধোর করে আমাদের হুমকি দেওয়ায় বিদ্যালয়ের সদস্যসহ ৪ জনের নামে কুলিয়ারচর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছি।

একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগেও অনেক অভিযোগ এসেছে। আমার সিনিয়র স্যারের নির্দেশে তদন্ত কার্যক্রমের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

দরপত্র ছাড়াই ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে ওই দপ্তরী গোপনে বিদ্যালয়ের মালামাল বিক্রি করার চেষ্টার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল আলিম রানা বলেন, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি কর্তৃক একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। দু'এক দিনের মধ্যে তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ করা হবে।

(এসএস/এএস/ডিসেম্বর ০৫, ২০২২)