বজলুর রশীদ : সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর মত সেদিনও আমি যথারীতি চাকরিতে। ২০০৯ এর ১২ মে। ওইদিন ছিল আমার ৮টা-৫টা ডিউটি। বেলা ৪টার দিকে হঠাৎ করেই লিমার ফোন। ফোন করেছে হাসপাতাল থেকে। কথা না বাড়িয়ে চটজলদি বাসায় ফিরে লিমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দৌড় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ট্রেনে-বাসে চেপে কক্সওয়েল। আমাদের বাসা থেকে আধাঘণ্টার দূরত্ব। বাস থেকে কক্সওয়েল-এ নামতেই যে কারো চোখে পড়বে সেই বিশাল ভবন। খুঁজে পেলাম আমার স্ত্রীকেও (লিমা)। কিন্তু এ কী! তার তো থাকার কথা হাসপাতালে, এতো মনে হচ্ছে কোনো ফাইভস্টার হোটেল। লিমার কাছ থেকে জানলাম, ভাবেসাবে হোটেলের মতো দেখালেও আসলে এটাই ‘টরন্টো ইস্ট জেনারেল হসপিটাল’।

 

ডিউ ডেটের দু’সপ্তাহ আগে লিমা গিয়েছিল হাসপাতালটা দেখে আসার জন্য। হঠাৎ করে যেতে হলে কীভাবে যাবে তার একটা ট্রায়াল হিসেবে। সেজন্য সে বাসা থেকে ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে গেছে। এসবই ছিল তার নিছক মহড়া। মহড়া দিতে গিয়েই সে ধরা খেয়ে গেছে। নার্স-ডাক্তাররা আর তাকে ফিরতে দেয়নি। হাসপাতালে ঢোকার মুখে রিসেপসন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে ৬ তলায় ‘লেবার রুমে’ নেওয়া হয়েছে। পরে শুনেছি, সেসময় হাসপাতালের স্টাফদের আতিশয্যে সে ভীষণ সংকোচ বোধ করছিল। সে আসলে ট্রেনে-বাসে করেই হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল-সেরকম সুস্থও ছিল সে; শুধু রিহার্সেলের কারণেই ট্যাক্সিতে যাওয়া। এমন একটা হাঁটতে-চলতে পারা পুরোপুরি সুস্থ মানুষকে তারা এতটা যত্ন-আত্তি করবে- সে আসলে এটা ভাবতে পারেনি। শুরু হয় হাসপাতাল সম্পর্কে চিরাচরিত ভাবনা আর এখানকার বাস্তবতার প্রচণ্ড অমিল।

একটা সুন্দর পরিপাটি ছিমছাম কামরা। বিরাট বড় জানালা দিয়ে ¯স্প্রিং-এ নতুন করে জেগে ওঠা বাইরের সবুজ গাছপালা আর দূর-দিগন্ত সবই চোখে পড়ছে। বাইরে তখন বিকেলের শান্ত শহর। সূর্যের লালাভ আলোয় ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু আলো-ঝলমল দেখাচ্ছে। মনে পড়ছে শৈশবের কথা। এমন বিকেলে ধান কেটে নেওয়া মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর সে কী মজা! আমার স্ত্রীও বাইরে তাকিয়ে মাঝেমাঝে আনমনা হয়ে পড়ছে। তবে সেও কী তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে হারিয়ে যাচ্ছে! সময়ের সাথে সাথে মানুষ কীভাবে বদলে যায়; না? প্রকৃতির এ এক অদ্ভুত খেয়াল। ছোট্ট শিশু, দুরন্ত কিশোরী, উচ্ছ্বল তরুণী। সেই কী না আজ আবার মা হতে চলেছে। হয়তো এসব নানান ভাবনাই তাকে আনমনা করে তুলছে।

তারপর টানা ৪ দিন সেই হাসপাতালে থাকা। এরমধ্যে আমাদের প্রথম সন্তান জেমিমা ভূমিষ্ট হয়েছে। এখানে ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর নাম রাখতে হয়। সেই নাম পরবর্তীতে বদলানোও বেশ ঝামেলা। সেজন্য নাম ঠিক করেই হাসপাতালে যেতে হয়। আমরা বেশ আগেই জেমিমা নাম ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার খুশীর শেষ নেই। আমি এখন একজন গর্বিত বাবা। ন্যাচারাল ডেলিভারি হলেও প্রসব-পরবর্তী লিমার অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। ওই সময়টা ভীষণ টেনশনে কেটেছে। লিমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন-রোগীর অবস্থা ভালো না। আমি সদ্য ভূমিষ্ট মেয়েকে নিয়ে এ অবস্থায় কী করব ভেবে পাচ্ছি না। নার্সরাই জেমিমার যাবতীয় টেক-কেয়ার করছে। আমি শুধু বাইরে অসহায় পায়চারি করছি। সঙ্গে একজন প্রাণী নেই, যে এ সময়ে অন্তত একটু সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারে। ৬/৭ ঘণ্টা পর লিমার দেখা মিলল। সবকিছু সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আমি অদ্ভুত বিস্ময়ে দেখলাম ডাক্তার-নার্সরা রোগীদের প্রতি কী ভীষণ মমতাময়ী। অত্যন্ত পেশাদারী মনোভাব, আন্তরিকতা আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক জটিল বিষয়ও তারা অত্যন্ত দ্রুত এবং সহজে সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের হাসপাতাল ছাড়ার মুহূর্তে। আমি ভাবছিলাম অন্তত হাজারখানেক ডলারের বিল তো ধরিয়ে দেবেই। মনে মনে সেরকম একটা প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলাম। সবকিছু গোছগাছ করা হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি মা-মেয়ের ‘রিলিজ পেপার’-এর জন্য। একজন নার্স এসে হাসপাতাল ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দিয়ে গেলেন। আমি ভেবেছিলাম এর মধ্যেই হয়তো বিলের কাগজটিও থাকবে। খুঁজে পেলাম না। অগত্যা আমি নিজেই গেলাম ‘অনুসন্ধান ডেস্কে’ বিষয়টার সুরাহা করতে। আমি কোনো ভূমিকা না করে আমাদের কত টাকা বিল হয়েছে জানতে চাইলাম। ডেস্কের ওপাশে বসা মহিলা শুধু ছোট্ট একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন। ‘নাথিং’। এরপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। কোনো কিছুই আমাকে পে করতে হবে না? অবাক কাণ্ড!

মনে পড়ে ঢাকার হাসপাতালের স্মৃতি। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোর যে অবস্থা, সুস্থ মানুষও কয়েকদিন থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। ঘরে থাকলে হয়তো তাও ক’দিন বেঁচে থাকা যেতে পারে, হাসপাতালে ভর্তি হলে আর রক্ষা নেই! সরকারি ব্যবস্থার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গত এক দশকে ব্যাঙের ছাতার মতো অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক। কিন্তু এসব কাদের জন্য? দেশের ৮০ ভাগ মানুষের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে তাদের এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নেয়া শুধু স্বপ্নেই সম্ভব! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যবসা শুধু রাজধানী আর বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বল এলাকায় পর্যন্ত। প্রত্যেকটি উপজেলা সদরে একটি করে সরকারি হাসপাতাল আছে, আছে ইউনিয়নে ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ডাক্তাররা সেখানে বসতে পছন্দ করেন না। তারা পছন্দ করেন ক্লিনিকগুলোতে বসতে। ফলে অসহায় রোগীদের অনেককে বাধ্য হয়েই ক্লিনিকমুখো হতে হচ্ছে। সারা বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে গ্রামের কৃষকের যে দু’পয়সা আয় হয়, অসুস্থ বৌকে নিয়ে একবার ক্লিনিকে গেলে তার বারো আনাই শেষ।

আর এখানে- কানাডায়, আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বলতাম এসব পুঁজিবাদী দেশ। সেই পুঁজিবাদী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের তারুণ্যের স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্যসেবাকে হার মানিয়ে দিতে বসেছে। বাংলাদেশে জামাই-আদর বলে একটা কথা প্রচলিত আছে, এখানে রোগীরা হাসপাতালে সেই যত্ন উপভোগ করছে। রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত রোগী হাসপাতালে থাকবেন, খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ-পত্র সবই সরবরাহ করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর এসবই বিনামূল্যে। একটি কানা-কড়িও খরচ করতে হবে না রোগীকে। এমন ব্যবস্থা যদি আমার বাংলাদেশে হতো!

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক