মাঈনুল ইসলাম নাসিম : এথেন্সে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক টানা পৌনে ২ বছর নিরলস পরিশ্রম এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে আলোর মুখ দেখেছে সরকার প্রধান পর্যায়ে গ্রীস-বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ইতালির বানিজ্যিক রাজধানী মিলানে অনুষ্ঠিত এশিয়া-ইউরোপ মিটিং (আসেম) সম্মেলনের প্রথম দিবসে ১৬ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার গ্রীক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও সামারাসের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে মিলিত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ফলপ্রসু হবার প্রেক্ষিতে এথেন্সের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পথ প্রশস্ত হয়েছে সহসাই ঢাকায় গ্রীক দূতাবাস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। দু’দেশের মধ্যকার আমদানি-রফতানি তথা বানিজ্যের ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত রাখতে চলমান বেশ কিছু বাধাও অপসারিত হয়েছে দীর্ঘ প্রতিক্ষীত এই বৈঠককে ঘিরে।

১৮ অক্টোবর শনিবার রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ এই প্রতিবেদককে জানান, “আসেম শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীন দুই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তাবটি প্রথম গ্রীক সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল এবং ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরের দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপের কারণেই আমাদের আজকের এই অর্জন”। এশিয়ার এতোসব দেশ থাকতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেন বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল গ্রীক সরকার, জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ বলেন, “এদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কারোলোস পাপোলিয়াসের কাছে গত বছর পরিচয়পত্র পেশ করতে গিয়ে তাঁর নিকট বেশ কিছু অনুরোধ আমি রেখেছিলাম বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় এবং পরবর্তীতে গ্রীক পার্লামেন্টের স্পিকারের সাথেও আমি দেখা করি”।

রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ আরো জানান, “গ্রীক শিপিং মিনিস্টার সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র মন্ত্রীদের সাথে একাধিকবার আমার বৈঠক হয় বাংলাদেশ ইস্যুতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও সামারাসের সাথেও বেশ কয়েকবার শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগ হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। প্রতিটি সুযোগেই আমি তাঁদেরকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, হয় গ্রীক প্রধানমন্ত্রী যাতে বাংলাদেশ সফর করেন নতুবা যে কোন সম্ভাব্য সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যেন সরকার প্রধান পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রদূত হিসেবে রুটিন ওয়ার্কের পাশাপাশি ব্যাপক গ্রাউন্ডওয়ার্কের কারণে গ্রীক কর্তৃপক্ষ আমাকে কথা দিয়েছিলেন এবং তাঁরা কথা রেখেছেন”।

রাষ্ট্রদূত কর্তৃক সম্পন্নকৃত গ্রাউন্ডওয়ার্কের রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাইলে পূর্ণ সচিব পদমর্যাদার পেশাদার কূটনীতিক গোলাম মোহাম্মদ স্মরণ করেন গত বছর এপ্রিলে ‘নেয়া মানোলাদা’ স্ট্রবেরি খামারে গুলীবর্ষনের ভয়াবহ ট্র্যাজেডির কথা। তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব আমি সুষ্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই গ্রীক প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো যখন আমার ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল স্ট্রবেরি ফায়ারিং ইস্যুতে তাদের মতো করে মুখ খুলতে, তখন ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে গ্রীক-বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অনেক কিছুই আমাকে মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে”।

রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিশেষ ভূমিকার ফলেই গুলীবর্ষনের ৬ মাসের মাথায় আহত ৩৫ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে ১ বছরের স্টে পারমিট দিয়ে বৈধ করে নেয় গ্রীক সরকার। স্টে পারমিট প্রদান অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে উপস্থিত ছিলেন। উক্ত ৩৫ জন বাংলাদেশি তাদের স্টে পারমিট নবায়নও করে নিয়েছেন সম্প্রতি। রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ বলেন, “স্ট্রবেরি খামারে গুলীবর্ষনের ঘটনা গ্রীক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, তা রিকভার করার অংশ হিসেবে এবং একধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেও বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সাথে বৈঠক করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয় গ্রীক প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে”।

এথেন্সের পররাষ্ট্র দফতরের এশিয়ান ডেস্কের তৎপরতার কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ।তিনি বলেন, “গ্রীক সাইপ্রাস এবং তুর্কি সাইপ্রাস বিবাদ মীমাংসায় বাংলাদেশ বরাবরই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অবিভক্ত (ইউনাইটেড) সাইপ্রাস প্রতিষ্ঠার নীতিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং বাংলাদেশের এই অবস্থানকে শুরু থেকেই অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে গ্রীক প্রশাসন”। রাষ্ট্রদূত আরো জানান, “গ্রীক সরকার বাংলাদেশকে একটি মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে জানে এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকাকে সবসময় রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ মিলানে দু্ই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে গ্রীসের তরফ থেকে বিষয়টি লাইমলাইটে নিয়ে আসা হয়”।

প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও সামারাসের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশে গ্রীক বিনিয়োগের ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ এই প্রতিবেদককে বলেন, “দু’দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিপিং সেক্টরে সম্ভাব্য এই বিনিয়োগটি হতে পারে অনায়াসে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রতি মুহূর্তের আপডেট গ্রীক বানিজ্য ও শিপিং মন্ত্রণালয়ে রয়েছে”। গ্রীক শিপিং মিনিস্টারের সাথে ফলপ্রসু বৈঠকের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশের শিপিং সেক্টরে বিনিয়োগের ব্যাপারে গ্রীক সরকারের আগ্রহের কথা তিনি আমাকে জানিয়েছেন এবং অচিরেই বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারেও তিনি তাঁর আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন”।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে গ্রীস বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তেমন কোন অগ্রগতি ছাড়াই অতিবাহিত হয় প্রায় ৩ যুগ। ৩৭ বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে এথেন্সে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ দূতাবাস, কিন্তু ততোদিনে চরম অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে পৌঁছে যায় সুপ্রাচীণ গ্রীক সভ্যতার পাদপিঠ। সংকট সত্বেও দু’দেশের আমদানী রফতানি বানিজ্য ক্রমশঃ বাড়ছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। ইউরোর হিসেবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে গ্রীসে এসেছে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরোর পন্য, যার মধ্যে রয়েছে যথারীতি রেডিমেইড গার্মেন্টস, পাটজাত সামগ্রী, ফুটঅয়্যার ও সিরামিক। এর বাইরে গ্রীক জাতীয় টেলিকম প্রতিষ্ঠান ‘ওটে’ এবং গ্রীক ফায়ার সার্ভিসের অফিসিয়াল ইউনিফর্মের পুরো চালানই আসে বাংলাদেশ থেকে।

অন্যদিকে একই অর্থবছরে গ্রীস থেকে বাংলাদেশে আমদানী করা হয়েছে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইউরোর পন্য যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল, মেশিনারিজ ও বিশেষ কিছু মেডিসিন। গ্রীক অলিভঅয়েল এবং দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রীরও চমৎকার বাজার সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশে। জাহাজ ভাঙ্গার মতো শিল্পেও বাংলাদেশের ভূমিকা অজানা নয় গ্রীসে। বাংলাদেশের এই সেক্টরটিতে বিশেষভাবে আগ্রহী গ্রীক জাহাজ ব্যবসায়ীরা। গ্রীসের পরিবেশবাদী গ্রুপগুলোর কারণে সরকারীভাবে প্রকাশ্যে কিছু না বলা হলেও দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে হয়ে যাওয়া বৈঠকটি গ্রীক বেসরকারী জাহাজ ব্যবসায়ীদেরকে চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙ্গার লোভনীয় বাজারটি ধরতে আরো সহায়তা করবে বলে জানা যায়।

রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ জানান, “জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়াররাইন্সে সাম্প্রতিককালে চালুকৃত ই-টিকেটিং প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন করার পাশাপাশি সিস্টেমটি দেখাশোনা করছেন একজন গ্রীক আইটি কনসালটেন্ট। আসছে দিনগুলোতে অন্যান্য আইটি সেক্টরেও দু’দেশ একসাথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে সহজেই”। নারীর ক্ষমতায়ণে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রাকে গ্রীক প্রশাসন দারুণ সমীহ করে বলে জানান রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দুই নেতার সফল বৈঠক হয় মিলানের আসেম সম্মেলনস্থলে, গ্রীস-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নবদিগন্তের এই মাহেন্দ্রক্ষণে তৃপ্তির সাথে এমনটাই জানান সফল রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ।

(এএস/অক্টোবর ১৯, ২০১৪)