দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জণ পর্যন্ত আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি দেশের ক্রান্তি কালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশিয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার উদ্দেশে যাত্রা করার দিন টি ছিল ২৩ জুলাই’৭১ (৬ শ্রাবণ ১৩৭৮) শুক্রবার রাত ৯ টায় আমি এম.পি.এ জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমরা এক সাথে ২২ জন রওনা হলাম। তারা ২৫ মার্চ’৭১ অপারেশন সার্চলাইট নামক বিশে^র জখন্নতম জ¦ালাও,পোড়াও ও হত্যা সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ শুরু করেছে। তখন সারাদেশের অধিকাংশ স্থান তাদের দখলে। টিক্কা খানের প্রলোভনে আমাদের দেশের জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলামী অধিকাংশ দল তাদের সহযোগি হয়েছে। তখন সারা দেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার জন্য পিচ কমিটি, রাজাকার, আল-বদর,আল-শামস ও অন্যান্য বাহিনী গড়ে উঠেছে।

সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা জ্বালাও, পোড়াও, লুটতরাজ, হত্যাা, গণহত্যা নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ করে চলেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করছে এদেশের বিভিন্ন স্বাধীনতা বিরোধীরা। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে নিশ্চিত মারা যাব। এই ভেবে বাবা-মা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে সম্মতি দিতেন না। তাই বাবা কে না জানিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। রওনা হওয়ার আগে মাকে একটা চিরকুট লিখলাম। “ মা, প্রনাম নিও, বাবাকে আমার প্রনাম দিও। বড় দাদা, মেজদাদা, ও বৌদিকে প্রনাম দিও। ছোট ভাই বোনকে স্নেহাশিষ দিও। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। তোমাদেরকে বলে গেলে যেতে দিতে না জন্য না বলে চলে গেলাম। অপরাধ ক্ষমা করিও। আশীর্বাদ করিও। আমি যেন বিজয়ী হয়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। ইতি- তোমার ছেলে দেবেশ।”

যাবার সময়ে বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাইনি। আমরা সুজানগর সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। এম.পি.এ স্যার আমাদের কে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষনের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের উদ্দেশে কলিকাতা চলে গেলেন। আমি প্রথমে ভর্তি হলাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়সের স্বল্পতার কারণে প্রথম ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। কয় এক দিন ভারতে বিভিন্ন স্থানে ঘুরলাম। আবার ফিরে এলাম কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। আমাকে ভর্তি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করলাম। কর্তৃপক্ষ আমার একটা ইন্টার ভিউ নিলেন। আমার দেশ প্রেম, সাহসী মনোভাব ও অন্যান্য শুনে ভর্র্তি করলেন।

প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে শুধু আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হত আর পিটি প্যারেড করানো হত। কদিন কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকার পর আমাকে ও রবীন্দ্র নাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও মো: নজরুল ইসলাম কে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ট্রানজিট ক্যাম্পে, তারপর মালঞ্চ থেকে কুড়মাইল ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে থেকে আমাদের কে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো দাজিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। এই ট্রেনিং ক্যাম্প টি ছিল ভারতের শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক স্থানে। পানিঘাটা স্থান টি ছিল চারি দিকে পাহাড়ের মধ্যে। কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শে¦র বনাঞ্চল। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেক কে একটা মগ, একটা প্লেট দেওয়া হলো।

ট্রেনিং শুরু হলো। আমাদের ২১ দিনের ট্রেনিং হলো। আমাদের কে থ্রিনট থ্রি রাইফেল এস,এল,আর ষ্টেনগান, টুইঞ্চ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, ফাষ্ট এইড সহ অন্যান্য ট্রেনিং দিল। যুদ্ধে সহযোদ্ধা আহত হলে করণীয় সর্ম্পকে ফাষ্ট এইড সম্পর্কে ধারণা দিল। ভারতীয় কয়েক জন হিন্দু বিহারী ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষন দিল। প্রধান প্রশিক্ষক শিখ সেনা ডি.এস. ভিলন স্যার এর কাছ থেকে জানলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। ট্রেনিং শেষে আমাকে রবীন্দ্র নাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম ও রতন কুমার দাসকে নিয়ে আসা হলো ৭ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ করা হলো। আমাদের গ্রুপের গ্রুপ লিডার হলেন বেলুকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান, ডেপুটি লিডার হলেন বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী।

আমাদেরকে তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেট মানি দেওয়া হলো। মৃত্যু যে হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, একটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসন ষ্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন বদলাতে হলো। আসাম গামী ট্রেনে উঠলাম। ভারতীয়রা আমাদেকে জয় বাংলার লোক বলতো। সরকারি বাস ও ট্রেনে টিকেট চাইতে এলে “জয় বাংলা” বললেই আর টিকেট বা ভাড়া চাইতো না। আসাম গামী ট্রেনে ধুবরী নামক ষ্টেশনে আমরা নামলাম। বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা বডিং এ থাকলাম। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা স্নান খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌছানোর জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯:০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। ইহা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর’৭১। নৌকা বাহাদূরাবাদ ঘাটের সম্মূখ দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরে ছিলাম। বাহাদূরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পীড বোর্ট নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

আমাদের কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার নির্দেশ দিলেন আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হায়েনারা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না। রাত ২.০০ টার দিকে আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। ভগবানের কৃপায়-ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলোনা। আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া গুড় ছিল। ভোরে এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ডুকিয়ে দিয়ে প্রাত:ক্রিয়া করলাম। তার পর নৌকা ছাড়লো। তখন কাজিপুর থানার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজিপুর থানার সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে শুনে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন ভরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্তাঞ্চল যমুনার চরে। ইহা ছিল টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির কাছাকাছি। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল।

মাঝিরা কোন রকমে রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এই ভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। একদিন রাতে যমুনা নদীর এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। অক্টোবর’৭১ মাসের মাঝা মাঝির আগ পযর্ন্ত আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কম থাকায় সম্মূখ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কমান্ডার স্যার নেন নি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার জন্য গেরিলা কার্যক্রম হিট এন্ড রান চালাতাম। ক্যাম্পের নিকট বর্তী গিয়ে ২/৪ টা থ্রি নট থ্র্রি রাইফেলের আকাশ মুখি গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। পাকিস্তানি দালাল, পীচ কমিটির লোক ও অন্যান্যরা আমাদের অস্তিস্তের কথা জানতে পারতো।

আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ছিল দুই পক্ষ। একটি স্বাধীনতার পক্ষে অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষে। স্বাধীনতা বিপক্ষের পীচ কমিটির সদস্য,রাজাকার, আলবদ, আলশামস ও অন্যান্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারীদের তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসে বাড়িঘরে আগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ,চাঁদাবাজি করতো। বাড়ির মালিকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতো। হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল ওদের বড় টার্গেট। হিন্দু নারী পুরুষকে ধরে নিয়ে যেত। নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করতো। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কোন স্বাধীনতা বিরোধীকে ধরি নাই, অত্যাচার বা হত্যা করি নাই। আমরা বুঝিয়ে বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার চেষ্টা করতাম। আমাদের গ্রুপের কাছে বেলকুচি রাজাকার ক্যাম্পের ৫ জন সশস্ত্র রাজাকার অস্ত্র সহ পালিয়ে এসে আত্মসমর্পন করে ছিল। আমরা আমাদের শেল্টার পালা ক্রমে দু’জন করে করে নিজেদের কে পাহাড়া দিতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশ ওয়ার্ড দিতেন। আমরা রাতে বিভিন্ন রাজাকারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বুঝাতাম। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম ও পরিস্কার করতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবুও আমাদের কে সহজ সরল মানুষ গুলো শেল্টার বা খাবার দিতে চাইতেন না। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার।

তারা খোঁজ জানলে পার্শ্ববর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিককে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কমীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে আমার পিতৃদেব ও মাতৃদেবী পাগল প্রায় হয়ে গিয়ে ছিলেন। আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গোটা পরিবার ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চড় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। আমাদের গ্রুপের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আরো প্রয়োজন হওয়ায়। কামান্ডার স্যার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আনার জন্য সিরাজগঞ্জের এম.এন,এ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদার এর ভায়রা ঝাঐল গ্রামের মো: আব্দুল হামিদ তালুকদার কে পাঠালেন। মো: আব্দুল হামিদ তালুকদারের কাছে আমি আমার পিতৃদেব মাতৃদেবী ও পরিবারের অন্যান্য পরিচয় লিখে দিলাম। তিনি মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আমার বাবা মা ও অন্যান্যদের সাথে দেখা করলেন।

আমার পিতা-মাতা আমাকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মো: আব্দুল হামিদ তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে দিলেন মেজ দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল কে। তিনি ৬ নভেম্বর’৭১ দৌলতপুর গ্রামে মো: শামসুল হক এর বাড়িতে এসে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমার মেজদাদা আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী কে বললেন “আমার ভাই দেবেশের জন্য বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। ভাইকে ফিরিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী আমার মেজ দাদা কে বললেন-“আপনিও আমাদের সাথে থাকুন আপনাকে আমরা ট্রেনিং দেওয়ায়ে মুক্তিযুদ্ধ করার উপযুক্ত করে নিব। এখন ভারতে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ দেবেশের নামে অস্ত্র ইস্যু করা আছে। অল্প দিনের মধ্যে দেশ স¦াধীন হবে। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কথা মেজদা মেনে নিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী ও অন্যান্যদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিলেন। কোথায় ও আক্রমণে পূর্বে আমরা রেকী করে দেখতাম। তারপর আক্রমন করতাম।

আমরা ১, বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ ২, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহন করা ট্রেন ধংস করার পরিকল্পনা ৩, কল্যানপুর যুদ্ধ ও ৪, শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রত্যেকটি যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পেশাদার ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ। আমরা ‘জয় বাংলা’ বলে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করেছে। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে ২ জন রাজাকার কে জ্যান্ত ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেধে আমাদের বানিয়া গাতী শেল্টারে রেখে ছিলাম। আমি তাদের চোখ বাধা খুলে দিলাম। তাদের কে বিভিন্ন ভাবে বুঝালাম। রাত্রিতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারে কে বলে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। আমরা সকল যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। যুদ্ধ জয়ের পর ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার আমাদের সকল অস্ত্র সিরাজগঞ্জ ইব্রাহিম বিহারীর বাসায় অস্ত্র জমা নেওয়া ক্যাম্পে জমা দিয়ে দুই সহোদয় বাড়িতে চলে আসি”।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।