উজ্জ্বল হোসাইন : গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)’র গণমাধ্যম মাস্টার্স ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সাগরকন্যা কুয়াকাটায় শিক্ষা সফর সম্পন্ন হয়েছে। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ব্যাচের কোর্স কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক পঙ্কজ কর্মকারের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

শিক্ষা সফরে সাথে ছিলেন পিআইবি স্টাফ আলাউদ্দিন ও রানা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন : আল-ইহসান, আল ইমরান, আরিফুর রহমান তুহিন, অসিম আল ইমরান, এসএম আশরাফুল আলম, আয়েশা জান্নাত, বিল্লাল হোসাইন, ইঞ্জিঃ বাকের সরকার, হোসাইন নূর, মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, মিকাঈল হোসেন, মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, মুরসালিন জুনায়েদ, মুসা মনির, নূরুল আমিন, রবিউল হাসান, রহিম ফরায়েজী, রাজিবুল ইসলাম, মোঃ তৌহিদুল ইসলাম মোঃ সাইফুল ইসলাম, সাইফুল্লাহ সাইফ জুয়েল, শাহ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, তারিক ইমন, উজ্জ্বল হোসাইন, জায়েদ হাসনাইন, এম গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।

গত ২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় পিআইবি থেকে ইউনিক বাসে সকলে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা রাত ১০টার মধ্যেই পিআইবি-এর আঙ্গিনায় চলে আসেন। এরপর সকলে শৃঙ্খলার সাথে বাসে আরোহন করেন। শুরুতে সেলফি তুলতে একেকজন ব্যস্ত থাকেন। তারপর ইঞ্জিঃ বাকের সরকারের স্পন্সরকৃত শিক্ষা সফরের টি-শার্ট। এরপর গাড়ি দ্রুত বেগে এগিয়ে চলে পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। রাস্তার পাশে সংকেতে দেখা যায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ৫৫ কিলোমিটার। অনেক প্রশস্ত রাস্তা। দুপাশে সজ্জিত। সড়কবাতির আলোয় মনকাড়া দৃশ্যের অবতারণা হয়। মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পূর্বপ্রান্তে। তখন অনেকেই সেটির ভিডিওধারণ করেন। সকলের আগে শিক্ষার্থী মুরসালিন জুনায়েদ হেলপারের জায়গায় দাঁড়িয়ে যান ভিডিও ধারণের জন্যে। তার দেখাদেখি লেখকও হেলপারের সিটে বসে ভিডিও ধারণ করেন। ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচটি ফ্লাইওভার পার হয়েছি-কদমতলী-বাবুবাজার লিংক রোড ফ্লাইওভার, আর এক্সপ্রেসওয়ের জুরাইন, কুচিয়ামোড়া, শ্রীনগর ও আটিতে চারটি। রেলওয়ে ওভার ব্রিজও পার হয়েছি। আরো পার হলাম চারটি বড় সেতু। সেতুগুলো হলো : ধলেশ্বরী-১, ধলেশ্বরী-২, আড়িয়ালখাঁ এবং কুমার সেতু। পদ্মা সেতুর মূলপ্রান্ত থেকে ওপারে জাজিরা প্রান্তে যেতে ৯-১০ মিনিটি সময় লাগলো। যেটি দেখা গেলো, এপার থেকে ওপারের সৌন্দর্য অনেকটাই বেশি। কারণ গ্রাম্য একটা পরিবেশে এতো সুন্দরভাবে শহরের ছোঁয়া লেগেছে, যা দেখে সকলে সত্যিই অভিভূত।

জাজিরা প্রান্তের দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এতে রয়েছে ৪ লেনের ডুয়েল ক্যারেজওয়ে। মোট রাস্তা ২৭ দশমিক ৬ মিটার। ৫টি সেতু, ২০টি বক্স কালভার্ট, ৮টি আন্ডারপাস সংযোগ তৈরি করেছে ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড ও ৩ কিলোমিটার স্থানীয় সড়কের। এছাড়া রয়েছে টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, সার্ভিস এরিয়া-০৩, ওয়ে স্টেশন, ইমারজেন্সি রেসপনস এরিয়া ইত্যাদি।

গাড়ি ছুটে চললো কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। পথে যাত্রা বিরতি হলো হাইওয়েতে এলাহী রেস্টুরেন্টে। শীতের হালকা হিমেল পরশে গাড়ি থামার সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। এলাহী হোটেলটি সুন্দর কারুকাজ খচিত। সেখানে সকলে একত্রিত হয়ে নাস্তা খেয়ে (গরম পরোটা, ডিম, ভাজি)। খুবই মজা করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার গাড়িতে আরোহন করলো। গাড়ি আবার ছুটে চললো। কখনও ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার আবার কখনো ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে। এরপর সকলের মধ্যেই একটু ঘুমের ভাব চলে আসলেও কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধ সকালটাই যেনো ছিলো অন্য রকম। অবশেষে ভোর সাড়ে ৫টায় শিক্ষার্থীরা কুয়াকাটা এসে পৌঁছলো। বাস থামার সাথে সাথে সকলে নেমে পড়লো। শিক্ষার্থীদের জন্যে পূর্ব থেকে নির্ধারিত গেস্ট হাউজ ‘আনন্দ বাড়ি’তে প্রবেশ করলাম। তিনতল বিশিষ্ট গেস্ট হাউজটি খুব সুন্দর ও পরিপাটি। ব্যাচের সিআর আশরাফুল আলম রিবলু কাউন্টার থেকে চাবি নিয়ে প্রত্যেকের জন্যে নির্ধারিত কক্ষ বুঝিয়ে দিলেন।

এরপর সকলে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে প্রায় ২ ঘণ্টার মতো বিশ্রাম নিলাম। নির্ধারিত সময়ে সকলে আবার গেস্ট হাউজের সামনে জড়ো হলো। আমাদের পঙ্কজ স্যার নির্দেশনা দিলেন পরবর্তী কর্মসূচির। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার, শিক্ষার্থীরা যে গেস্ট হাউজে উঠেছি সেটির সামনে রয়েছে বিশাল মাঠ, পাশে একটি বিশাল পুকুর। একটি অন্য রকম গ্রাম্য পরিবেশের ছোঁয়া খুঁজে পেলাম। এরপর মহিপুর হোটেল মেরিন ভিউতে সকালের নাস্তা সেরে চলে গেলো লেবুর বাগান, ত্রিমোহনা, কাঁকড়ার বিচ ও শুঁটকি পল্লীতে।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তির সাথে কথা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৩৮০ কিলোমিটার, বরিশাল থেকে ১০৮ কিলোমিটার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কুয়াকাটা কেনো নামকরণ হলো। তিনি জানালেন, কুয়াকাটা নামের ইতিহাস রয়েছে আরাকানীদের সাথে। কুয়া শব্দটি এসেছে কূপ থেকে। ধারণা করা হয়, ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানীরা এখানে এসে বসবাস শুরু করে। তখন এখানে সুপেয় জলের অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কূপ খনন করেছিলো। আর সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা।

শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সাইট ভ্রমণের সাথে উপভোগ করলো ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। যা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। বাংলাদেশের এটাই একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই অবলোকন করা যায়। সবচে’ ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় সৈকতের গঙ্গামতির বাঁক থেকে আর সূর্যাস্ত দেখা যায় পশ্চিম সৈকত থেকে।

এরপর প্রথমে সাগরের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা বেড়িবাঁধের রাস্তা ধরে শিক্ষার্থীরা চলে গেলো শুঁটকি পল্লীতে, যেখানে কয়েকটি শুঁটকির দোকান রয়েছে। তার পাশে কিভাবে প্রাকৃতিকভাবে মাছ শুকানো হয় সেটি দেখনো হলো। সেখান থেকে সমুদ্রের পাশ দিয়ে লেবুর বাগানে গেলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, লেবুর বাগানে কোনো লেবু গাছের চিহ্ন চোখে পড়লো না। স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, এখানে লেম্বু মগা নামে একজন বসবাস করতো, তাই এই স্থানটির নাম হয়েছে লেবুর বাগান।

সৈকতের কাছেই আছে প্রাকৃতিকভাবে ও সরকারি উদ্যোগে তৈরি ঝাউবন। সেখানে আছে ঝাউ ও নারিকেল গাছ। সৈকত থেকে শিক্ষার্থীরা বালিময় মাঠ পেরিয়ে ঝাউবনে পৌঁছলো। বনের মনোরম দৃশ্য ঊপভোগ করে ফিরে এলো। ঝাউবনের পাশেই রয়েছে একটি ইকোপার্ক, যেখানে পিকনিক হয়। এছাড়া ঝাউবনের পূর্বে রয়েছে গঙ্গামাটি রিজার্ভ ফরেস্ট। সমুদ্রের পাশ দিয়ে ত্রিমোহনা ও কাঁকড়ার বিচ গেলো। কাঁকড়ার বিচে খুব সুন্দর কাঁকড়ার দেখা পেলো। এর পাশেই ত্রি-মোহনা অবলোকন করলো। ত্রি-মোহনা থেকে আরেকটি দর্শনীয় স্থান দেখা গেলো, সেটি হলো ফাতরার বন সকলে পঙ্কজ স্যারকে বললো, ফাতরার বন যাবে। স্যার রাজি হলেন।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আমরা ১-২ ঘন্টা রেস্ট নেয়ার পর বিকেলে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্টে। সেখানে বিশাল সমুদ্র সৈকতে কিছুক্ষণ থেকে স্থানীয় প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দের সাথে পূর্ব নির্ধারিত মতবিনিময়ে মিলিত হলো শিক্ষার্থীরা। কুয়াকাটা সৈকতের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে পারস্পারিক মতবিনিময় হলো। কুয়াকাটা প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে তাদের সাংবাদিকতায় সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জানালেন।

আবার চলে এলো গেস্ট হাউজে। বারকিউতে অংশগ্রহণ করলাম। সেখানে হালকা শীতের আমেজে সকলে নেচে-গেয়ে রাতটি উপভোগ করলাম।

রাতের খাবার শেষে ক্লান্ত শরীরে হোটেল রুমে রাত্রিযাপন হলো। সকালে উঠে ফাতরার বন যাবো সেটি মাথায় রেখেই সকলে সুখনিদ্রা ভোগ করলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে অনেকে সূর্যোদয় অবলোকনে গেলেন। আমাদের সিআর সবসময়ই ফাস্ট। তিনিসহ আরো যারা এই শিক্ষা সফরটি সফল হতে সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন : আল-ইহসান, বিল্লাল হোসাইন, ইঞ্জিঃ বাকের সরকার, মুরসালিন জুনায়েদ, মোঃ সাইফুল ইসলাম, শাহ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, জায়েদ হাসনাইন প্রমুখ।

সকালে সূর্যোদয় দেখে তিনি হোটেল রুমে এসে আবার বাকিদের একত্র করলেন সকালের নাস্তা সেরে ফাতরার বন যেতে। আমরা কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে সিবোটে চেপে বসলাম।

রওয়ানা দিলাম ফাতরার বনের দিকে। সমুদ্র থেকে কুয়াকাটা সৈকত দেখতে খুবই মনোরম। মাঝে মাঝে সমুদ্রে দেখা মিললো ঝাঁকে ঝাঁকে গাংচিলের। সিআর সেগুলোর ছবি তুলতে ভুল করেননি। সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম ফাতরার বন। সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে যে ম্যানগ্রোভ বন, সেটিরই নাম ফাতরার বন। সংরক্ষিত বনভূমি ফাতরার বন ইতোমধ্যে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। এখানে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বানর, শূকরসহ অসংখ্য জীবজন্তু ও পাখি।

বোট থেকে নামতেই বনবিভাগের সতর্কবাণী-মেছোবাঘের অভয়ারণ্য। তাই সাবধানে চলুন। শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বনের ভেতর প্রবেশ করে অনেকদূর হাঁটার পর সমুদ্রের বেলাভূমির দেখা পেলাম। মনভরে সেটি দেখে আবার বোটে এসে বসলাম। এবার ফেরার পালা। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। এক ঘণ্টার যাত্রা শেষে ফিরে এলো। সকলে বোট থেকে নেমে সমুদ্র সৈকতের বিপণীতে কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে গেলো। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাস এসে গেলো। বাসটি ঠিক ৫টায় ছাড়লো। বরিশাল বিভাগের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে বাস চললো। পেছনে রয়ে গেলো গত দুদিনের ভ্রমণের নানারকম স্মৃতি। অতৃপ্তি রয়ে গেলো কিছু স্থান ভ্রমণ করতে না পারায়। সেগুলো হলো কুয়াকাটার কুয়া, বৌদ্ধ মন্দির, সীমা বৌদ্ধ মন্দির (যা সাঁইত্রিশ মণ ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি), ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি, কেরানিপাড়া, নৌকা জাদুঘর, আলীপুর বন্দর, মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, গঙ্গামতির জঙ্গল ইত্যাদি। যেহেতু শিক্ষার্থীদের সফরটি দুই দিনের ছিলো, তাই অনেক স্থানই আমাদের দেখা সম্ভব হয়নি।

সফরে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে, এখানে সারাবছরই প্রচুর পর্যটক আসে। শীতের এই সময়টিতে সবচে’ বেশি পর্যটক আসে, যা স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়। তবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, বীচের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, আবাসনের উন্নয়ন, রাস্তাঘাট সংস্কার ইত্যাদি কার্যক্রম বেসরকারি বা সরকারি উদ্যোগে বাস্তবায়ন করলে এটি হবে দেশের পর্যটন খাতের খুবই সম্ভাবনাময় একটি স্থান।

(ইউ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩)