গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বড়িকান্দি ইউনিয়নের থোল্লাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা, সলিমগঞ্জ এলাকার সুপরিচিত মুখ, বর্তমানে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শান্ত রায় সম্প্রতি এলাকার বহু লোকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে 'লাপাত্তা' হয়ে গেছে বলে একটি খবর এখন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে বেশ আলোচিত হচ্ছে। 

গত শনিবার থেকে ছাত্রলীগ নেতা শান্ত রায় 'আত্মগোপনে' আছেন বলে জানা গেছে। ফলে বহুল আলোচিত ঘটনাটি এখন 'টক অব দ্যা নবীনগর' এ রূপ লাভ করেছে। ইতিমধ্যে শান্তর বিরুদ্ধে নবীনগর থানায় প্রতারণার মোট আটটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। নবীনগর থানার ওসি সাইফুদ্দিন আনোয়ারও আটটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা আমাকে নিশ্চিত করেছেন।

ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ সমাজ সেবা সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক, সনাতন ধর্মের 'ইসকন' ভক্ত শান্ত রায় এলাকার বহু মানুষের কাছ থেকে তার পৈত্রিক স্বর্ণের ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে মুনাফা করবে বলে 'ধার' (হাওলাত) হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ৩ লাখ টাকা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সম্প্রতি এলাকা থেকে 'লাপাত্তা' হয়ে যায়।
দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ছাত্রলীগ নেতা শান্ত রায় রাজনীতির পাশাপাশি সিগারেট ও স্বর্ণের ব্যবসা করতেন। এলাকায় প্রচলিত আছে, চট্টগ্রামে তার পিতার কয়েকটি স্বর্ণের দোকান আছে। এর ভিত্তিতে তিনি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন এলাকায়। পরে ব্যাংক রেটের চেয়ে উচ্চ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সিগারেট ও স্বর্ণের ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেন। এতে মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে তুলে দিতো শান্তর হাতে। কয়েক বছর ঠিকঠাকভাবেই লেনদেন করছিলেন শান্ত। কিন্তু গত শনিবার থেকে তিনি এলাকায় নেই। অথচ শনিবার ও রোববার অনেককে টাকা ফেরত দেয়ার কথা ছিল। তাই শুরু হয় কানাঘুষা। তখন বেরিয়ে আসে একের পর এক টাকা নেয়ার তথ্য। যার পরিমাণ কয়েক কোটি হয়ে যাবে।

শান্ত রায়ের কাছে বাড়াইল গ্রামের হক সাব পান ৪০ লাখ। সুজন মিয়া পান ২০ লাখ। ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পান আব্বাস উদ্দিন। এছাড়া সগির মিয়া ১২ লাখ, শ্যামল চন্দ্র দাস আট লাখ ৬০ হাজার, অক্লান্ত চন্দ্র দেব নাথ তিন লাখ, নিলখী গ্রামের খোরশেদ আলম পাঁচ লাখ, থোল্লাকান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ৩৯ লাখ, থোল্লাকান্দি গ্রামের আতিকুর রহমান রনি তিন লাখ, বড়িকান্দি ইউনিয়নের মুক্তারামপুর গ্রামের শাহ জালাল ৫৩ লাখ, ধরাভাঙ্গা গ্রামের বাবলু মিয়া ১১ লাখ, বাড়াইল গ্রামের মাহফুজুর রহমান তিন লাখ, নরসিংদীর বাদল মিয়া পাঁচ লাখ টাকা পান।

এছাড়া সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে রিফাত আহম্মেদ থেকে ছয় লাখ, বড়িকান্দি ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম থেকে এক লাখ হাতিয়ে নিয়েছেন শান্ত।

ভুক্তভোগী হক সাহেব জানান, ‘শান্ত ও তার বাবা ব্যবসার কথা বলে আমার থেকে প্রায়ই টাকা নিতেন। আবার ফেরতও দিতেন। সর্বশেষ ৪০ লাখ নিয়েছেন। অন্য কারো থেকে টাকা নিতেন বলে আমার জানা ছিল না। এখন শুনতে পাচ্ছি, আমার মতো ৩০ থেকে ৪০ জন থেকেও কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন।’

সুজন মিয়া বলেন, শান্ত আমার বন্ধু। তার বাবা চট্টগ্রামে স্বর্ণের ব্যবসা করেন। স্বর্ণ ক্রয় করার কথা বলে কয়েক দিনের জন্য আমার থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। টাকাগুলো আমি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। গত শনিবার আমার টাকা ফেরৎ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাত থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ আছে।

শ্যামল চন্দ্র দাস বলেন, ‘শান্তকে অনেক বিশ্বাস করতাম বলেই আমি আট লাখ টাকা দিয়েছিলাম। (সূত্র: দৈনিক নয়াদগন্ত, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী (সুফি তত্তের গায়ক) বাউল এ আর জসীম খানকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানাতে নবীনগর থানার ওসি সাহেবের কক্ষে যাই। ওইসময় শান্তর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানাতে থোল্লাকান্দি গ্রামের তিনজন লোক ওসির কক্ষে এসে ঢুকেন। এদের মধ্যে সুমন নামের একজন জানান, শুধু তার (সুমন) কাছ থেকেই শান্ত স্বর্ণের ব্যবসা করার কথা বলে ৪৫ লাখ টাকা 'ধার' নেয়। সরল বিশ্বাসে সেই টাকা ধার দিয়ে এখন আমি মহা বিপদে পড়েছি।

এসময় ওসি সাহেব সুমনকে জিজ্ঞাস করছিলেন,'বিনা লাভে কি আপনি এতগুলো টাকা শান্তকে এমনি এমনি 'ধার' দিয়েছেন? কই আমি চাইলে তো, 'এক লাখ টাকাও আমাকে আপনি ধার দেবেন না....!!!

আমার দু’টি কথা

আমার প্রশ্নটাও ঠিক এখানেই। ওসি সাহেব যেমন করে জানতে চেয়েছেন, আমিও ঠিক তেমন করে টেলিফোনে ভুক্তভোগীদের কয়েকজনকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, এত লাখ লাখ টাকা শান্তকে আপনারা কিসের ভিত্তিতে ধার দিলেন? নিশ্চয় বিনালাভে আপনারা কেউ তাকে এত টাকা 'ধার' দেননি!

আজকাল অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং বাবার কাছ থেকে ছেলে কিংবা ছেলের কাছ থেকে বাবা যেখানে টাকা চেয়ে পান না, সেখানে শান্তর মতো এক যুবককে কোটি কোটি টাকা 'ধার' কেন ভুক্তভোগীরা দিতে গেলেন, সেটিই নানাভাবে নানারঙে এখন ইনিয়ে বিনিয়ে আলোচিত হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, শান্তর মতো সাধারণ এক ছেলের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটিতে পদ পদবী পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও এখন নানা মুখরোচক আলোচনা ফেসবুকে চলছে। কি করে শান্তর মতো গ্রামে থাকা (থোল্লাকান্দি) একজন সাধারণ ছেলেকে ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও জেলার এত উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করা হল, সেটি নিয়েও এখন মারাত্মক প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে গতকাল রাতে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ শোভনের সাথে কথা বললে, শোভন আমাকে জানান,'বিষয়টি তারা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে নবীনগর থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন। শিগগীরই বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে কথা বলে শান্ত রায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।'

এদিকে নবীনগর থানার ওসি সাইফুদ্দিন আনোয়ার গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে জানান,এ পর্যন্ত শান্তর বিরুদ্ধে আমরা আটটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।' তবে ওসি সাহেব এ বিষয়ে টাকা 'ধার' দেয়া এলাকার জনগণকে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

সম্প্রতি এরকম কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনা প্রায়ই নবীনগরে ঘটছে। এর আগে নবীনগর সদর, ভোলাচং ও সুহাতা গ্রামের তিনজনের বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ নিয়ে কয়েকদিন ফেসবুকসহ গণমাধ্যমে নানা মুখরোচক কাহিনী লেখালেখি হয়েছে। এসব ঘটনার কোন সুষ্ঠু সমাধান কিংবা প্রতিকার না হওয়ার কারণেই জঘণ্য এসব ঘটনা 'বন্ধ' হওয়ার পরিবর্তে বরং উল্টো একের পর এক এসব অপ্রত্যাশিত ও অনাকাংখিত ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে নবীনগরের সামগ্রিক ভাবমূর্তিও দেশে বিদেশে দারুণভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।

তাই এসব অনভিপ্রেত ও অনাকাংখিত ঘটনা রোধকল্পে জনগণের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি মাননীয় সংসদ সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল মহোদয়সহ স্থানীয় রাজনীতিবিদগণ, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, প্রশাসন ও বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের একটি যৌথ দিক নির্দেশনা আমরা বিনয়ের সঙ্গে কামনা করছি।

নয়তো একের পর এক ঘটে চলা এসব জঘণ্য কলংকজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত ঐতিহ্যবাহী নবীনগরের গৌরবোজ্জল ইতিহাস হয়তো একদিন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

পরিশেষে, কোটি কোটি টাকা 'ধার' দেয়া ভুক্তভোগীদেরকে বিনয়ের সঙ্গে বলবো, লোভে পড়ে যাকে তাকে যখন তখন লাখ লাখ টাকা এভাবে 'ধার' দিয়ে নিজেদের বিপদ এভাবে কখনও আর ডেকে আনবেন না। বরং আপনারা দানশীল মন মানসিকতা নিয়ে এলাকার হতদরিদ্র যে সব পরিবার টাকার অভাবে ঘরে থাকা উপযুক্ত মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না কিংবা টাকার অভাবে কোন পরিবারের মেধাবী সন্তান সন্ততিকে লেখাপড়া করাতে পারছেন না, আপনারা সেইসব অসহায় পরিবারগুলোর পাশে আর্থিকভাবে আপনাদের সাহায্যের হাতটুকু একটু প্রসারিত করুন, তাতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও আপনার প্রতি সন্তোষ্ট থাকবেন। প্রভু দয়াময় আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।

লেখক :বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলা ৭১ ও সম্পাদক, নবীনগরের কথা।