মোহাম্মদ ইলিয়াস


অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় একটি দিন। ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

একুশ মানে মাথা নত না করা। আজ বিশ্বের কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত হবে একুশের অমর শোকসংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।’ ভাষা শহীদদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে। আমরা পালন করি। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার কি প্রচলন হয়েছে আজো? আমরা জানি, আমাদের দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৪ সালে। সেই আদেশে বলা হয়েছিল: ইংরেজিতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা

প্রচলন আইনানুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছিল আদালত। আগেও আমরা এমন নির্দেশনা দেখেছিলাম। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হলো না। তা ভাবনার বিষয়।

আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। বাংলা সাহিত্যসম্ভার নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। এ সবকিছুই বাংলা ভাষার জন্য ইতিবাচক উপাদান। এ ছাড়া সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটিরও

বেশি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম–বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক ভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সংগত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষী হারিয়ে বিপন্নতার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য দায়ী কারা, তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে।

ভুল বানান, উচ্চারণ ও ইংরেজি ঢঙে বাংলা লেখা ও বলাটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলগুলোয় ইংরেজি-বাংলা মেশানো উদ্ভট উচ্চারণের বাক্যালাপে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপকসহ অংশগ্রহণকারীরা ‘গ্রেট’, ‘গুড মর্নিং’, ‘গুড ইভিনিং’, ‘গুড নাইট’ ও ‘বা-বাই’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। দশজনের কাছে নিজেকে স্মার্ট হিসাবে তুলে ধরার জন্য খুব সচেতনতার সঙ্গে বাংলার বদলে যতটুকু পারছেন ইংরেজি বলার কসরত করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষা তাদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাচ্ছে।

কোনো ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো শুদ্ধ বানান ও উচ্চারণে কথা বলা ও লেখা। শুদ্ধ-অশুদ্ধ যা-ই হোক, আমরা ইংরেজি লেখার সময় অনেক সতর্ক থাকি, পাছে যোগ্যতা ও স্মার্টনেস যদি ক্ষুণ্ন হয়! কিন্তু ভুল বানানে বাংলা লেখায় কারও দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। আর সেজন্য আমরা অশুদ্ধ উচ্চারণ ও বানানে বাংলা বলছি, লিখছি ও পড়ছি। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, শোধরানোর তাগিদ নেই, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে একই ভুলের চর্বিত চর্বণ করেই চলেছি।

বাংলা ভাষাকে আজ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি দেশের সরকারপ্রধানও বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এই সাধের ও প্রাণের ভাষা নিজ ভূমিতেই কতটা যে অবহেলার শিকার, তার নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে ভাষা ব্যবহারে অসচেতনতা দেখা যাচ্ছে। তারা যেনতেন ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে চায়। তাই তারা বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা লেখার সময়ও তারা ইংরেজিটাই বেশি লিখছে। তাঁরা বলেন, আগে একটা সময় ছিল যখন সবকিছুতেই

বাংলা ব্যবহারের চল ছিল। যেমন বাড়ি বা দোকানপাটের নাম রাখা, বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো– এগুলোতে বাংলা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই রীতিটা আর নেই। এখন সবাই ইংরেজি নাম রাখার দিকে ঝুঁকছে। এমনকি অল্প শিক্ষিত লোকজনও ভুলভাল ইংরেজিতে লোকজনকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেটা দুঃখজনক। এর জন্য তাঁরা মানুষের হীনম্মন্যতাকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলেন, মানুষ এখন মনে করে ইংরেজিতে লেখাটা গৌরবের বিষয়। তাই তাঁরা সেটাই করছেন।

রেডিও ও টেলিভিশনের চ্যানেল–সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অনুপাতে ভাষাচর্চা যদি হতো দিন–রাত, তাহলে অবশ্যই আনন্দিত হতাম আমরা। সব জীবিত ভাষা গতিশীল, যা ভাষাকে করে সংস্কৃত, আধুনিকতর। ফলে বানান পরিবর্তিত হয়, অব্যবহৃত শব্দ বাদ পড়ে। পাহাড়ি নদীর মতোই এর এগিয়ে চলা, ততই স্ফূর্তি। বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। এর শব্দ ভাণ্ডার অফুরন্ত। রয়েছে নানা বৈচিত্র্য এবং মাধুর্য। শিক্ষিত সমাজ, শিক্ষকদের এবং গণমাধ্যমের জন্য একটি পরিমিত বাংলা ভাষা দরকার। শিক্ষকরা যদি নিজেই ভালো বাংলা না বলতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখার কোনো সুযোগ নেই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করার আগে জরুরি হলো আমরা শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে এবং লিখতে পারি কিনা তা যাচাই করা। যারা বাংলায় লেখালেখি করেন তারা অবগত আছেন ব্যাকরণসম্মতভাবে বাংলা বাক্য তৈরি করা এবং শুদ্ধ বানানে বাংলা শব্দ লেখা কতটা কঠিন। প্রথমত, আমাদের কতগুলো বিষয় আইনগত বাধ্যবাধকতার ভেতর নিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই সর্বস্তরে বাংলা চালু হোক

আর এভাবেই বাংলা ভাষা বিশ্বায়নের ওপরে এক গভীর ও সুবিশাল প্রভাব বলয় তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও মুখরিত করে তুলবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভাষার ওপর কোনো ঔপনিবেশিক চাপ, চক্রান্ত ও ভাষা দূষণের মতো ন্যক্কারজনক কাজকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার জন্য ভাষা প্রেমিক সব মানুষের প্রধান কাজ।

১৯৫২ থেকে ২০২৩ সাল ৭১ বছর হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ অনেক বড় বাধার মুখোমুখি হয়েছে, আমরা তা অতিক্রম করেছি এবং আমরা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এবং যতদিন আমরা আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি মনে রাখব, ততদিন আমরা ততদিনই অদম্য থাকব। যতদিন আমরা আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মনে রাখব, ততদিন বাংলাদেশকে কেউ আটকাতে পারবে না। বাংলা ভাষা সহজ ও সমতলের পানে ছুটে যাওয়া। আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে হবে। শুদ্ধ চর্চা ও সুন্দর প্রয়োগের মাধ্যমে এ ভাষা আরো উজ্জ্বল ও বর্ণিল হয়ে উঠুক– সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ডে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা