ঈশ্বরদী প্রতিনিধি : বসন্ত এসেছে, র্জীণ প্রকৃতি তার নব রূপের পসরা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। হলুদের বর্ণছটায় সবুজ প্রকৃতির সাথে সাথে মানব মন ও সবুজ আর হলদে আভায় নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে। আর সেজন্যই বসন্তে ফসলের ক্ষেতের এমন দৃশ্য টানছে সৌন্দর্য পিপাসুদেরও। প্রকৃতিতে অসাধারণ এক রূপবান উদ্ভিদ ‘সূর্যমুখী’। পাগল করা সুন্দর তার ফুল। ফুল ও প্রকৃতিপ্রেমী যে কেউ এ ফুলের নান্দনিক হলদে আভায় মুগ্ধ না হয়ে পারে না। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল আকারের হলুদ গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কাছে গেলে চোখে পড়ে হাজার হাজার সূর্যমুখী ফুল। সূর্যমুখী হাসে, আর তার হাসিতে প্রকৃতি অপরূপ রূপে সাজে। ফুলগুলো বাতাসে দোল খেয়ে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সৌন্দর্য উপভোগ করার। হলুদ রংয়ের হাজারো ফুল মুখ করে আছে সুর্যের দিকে। 

ঈশ্বরদীর মতো সূর্যমুখী ফুলের এত বড় আকারের বাগান আগে পাবনা জেলার আর কোথায় দেখা যায়নি। আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের অভ্যস্তরের মাঠে ২ একরেরও বেশি জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। সূর্যমুখীর হলুদ আভায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। তাই দিনভর সূর্যমুখী বাগানে ভিড় করছে হাজারো মানুষ।

এ যেন সূর্যমুখী ফুলের রাজ্য। যতদূর চোখ যায়; ততদূর হলুদ রঙের ঝলকানি দেখা যায়। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজের মাঝে হলুদের সমাহার। সূর্যমুখী যেন সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। সূর্যমুখী ফুল শুধু দেখতে রূপময় নয়, গুণেও অনন্য। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সূর্যমুখী মাঠটি। বর্তমানে প্রতিদিন সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করছেন এখানে। বসন্ত হাওয়া বইছে চারপাশে। সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সকাল বেলা পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেলা বাড়া এবং সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীর মূখও ঘুরতে থাকে। একদিকে সূর্য পশ্চিম আাকাশে হেলে যাওয়ার দৃশ্য, অন্যদিকে সূর্যমুখী ফুল তাকিয়ে থাকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। মৌমাছিরা শেষ বিকেলে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সূর্যমুখী ফুল থেকে। তাছাড়া প্রতিদিন দেখা যায় প্রজাপতির মেলা। প্রাকৃতিক এ অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।

এখানে আসা দর্শনার্থীরা নির্মল বাতাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। আগত দর্শনার্থীর এক দল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত, আরেক দল নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত। অন্যদল ব্যস্ত টিকটকে ভিডিও তৈরিতে।

দর্শনার্থী আলমগীর হোসেন বলেন, ছুটির দিন বিধায় অনেক দূর থেকে আসতে পেরেছি। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ফুল আমার খুব ভালো লেগেছে।

সূর্যমুখী দেখতে আসা দর্শনার্থী ফাহমিদা শাপলা বলেন, শহরের ঘরবন্দী থেকে একটু মুক্ত হাওয়ায় বেড়াতে ও বাগান ভরা ফুল দেখতে এখানে আসা। তবে এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব সুন্দর লাগছে। তাই সবাই মিলে এ মনোরম দৃশ্য ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করছি।

কৃষি অফিস জানায়, ঈশ্বরদীর মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষাবাদের জন্য উপযোগী। কম সময় ও অর্থ ব্যয় করে সূর্যমুখী চাষ করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অপার। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলে ফুল থেকে তেল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে আধা লিটার তেল উৎপাদন সম্ভব। প্রতি বিঘা জমিতে ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন হয়। আর বিঘায় তেল উৎপাদন হবে ১৪০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত। প্রতি লিটার তেলের বাজার মূল্য ২৫০-৩০০ টাকা। বিঘাতে খরচ হয় সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে ভোজ্যতেলের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ার কারণে চাহিদা বেড়েছে সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের।

কৃষি বিভাগ আরও জানায়, সূর্যমুখী ফুলের তেল অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। তাই ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীদের জন্য এই তেল অন্যান্য তেলের চেয়ে অনেক উপকারী ও স্বাস্থ্যসম্মত। সূর্যমুখীর তেল কোলেস্টেরলমুক্ত, ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’ ও মিনারেল সমৃদ্ধ। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ। আর চাষও লাভজনক। বারি তিন খাটো জাতের সূর্যমুখী, এর কান্ডও বেশ শক্ত,ফলে ঝড় ঝঞ্ঝায় ক্ষতি কম হয়। তাই এটিকে এ অঞ্চলে চাষ উপযোগী হিসেবে শণাক্ত করেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা ।

আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তৈল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়ক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফেরদৌসি বেগম জানান, দেশে তেলের ঘাটতি মেটাতে ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী চাষের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরও লক্ষ্যে বারি-৩ জাতের নতুন সূর্যমুখী ফুলের ব্যাপক আবাদের মাধ্যমে দেশের ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটাবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার জানান, ঈশ্বরদীতে সূর্যমুখী চাষের বিস্তাার ও জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে স্থানীয় কৃষি বিভাগ নানাভাবে উদ্যোগ গ্রহন করে কাজ করছে।

ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও ঈশ্বরদী আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মহিউদ্দিন বলেন, খাটো জাতের এ সূর্যমুখি ফুলের তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এতে মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন-ই থাকায় মেয়েদের বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধ ও ত্বকের উজ্জলতার জন্য খুবই উপকারিতা রয়েছে। এজন্য জাতটি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

(এসকেকে/এসপি/মার্চ ০৪, ২০২৩)