মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : পড়াশোনা চলাকালীন বিয়ে হয়ে যায় মাহবুবা খান জ্যোতির। তিনি টাঙ্গাইল পৌর শহরের পূর্ব আদালত পাড়া এলাকার একজন পরিচিত মুখ।

মাহবুবা খান জ্যোতি একজন মা ও সফল নারী উদ্যোক্তা। সংসার সামলে নাম লিখিয়েছেন ব্যবসায়ীর খাতায়। এখন প্রতি মাসে প্রায় লাখ টাকা আয় করছেন । মাত্র ২৬০ টাকা পুঁজি নিয়ে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায়ে যাত্রা শুরু জ্যোতির।

বর্তমানে স্বাস্থ্যকর খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তার কাছে মিলবে পছন্দ অনুযায়ী ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর কেক, বিভিন্ন রকমের আচার, আমসত্ত্ব ও হাতে ডিজাইন করা শাড়ি, পাঞ্জাবিসহ বাচ্চাদের ফতুয়া।

জ্যোতির প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের নাম ‘স্বপ্নের সন্ধানে’। আমাদের দেশের মফঃস্বল এলাকার প্রচলিত ধারা ও ধারণাকে বদলে দিয়ে আজ তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। কোনো চাকরিতে যোগদান না করলেও ইচ্ছে ছিল তিনি নিজে কিছু করবেন। মেয়ে একটু বড় হওয়ার পর ভাবলেন কিছু একটা করা উচিত।

সে অনুযায়ী ২০২০ সালের প্রথম দিকে জয়েন করেন ‘উই’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে। সেখানে যুক্ত হওয়ার পর জানতে পারেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের ইতিবৃত্ত। সে বছরের জুন মাস থেকে শুরু করেন কাজ। নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করতে শুরু করেন আচার ও আমসত্ত্ব। ইতোমধ্যেই তার আমসত্ত্ব সাড়া ফেলেছে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায়, এমনকি দেশের বাইরেও।

তার তৈরি খাবারের গুণগত মান নিয়ে সন্তুষ্ট তার ভোক্তারা। টাঙ্গাইলে তিনি পেয়েছেন ‘আমসত্ত্ব জ্যোতি’ খেতাব। ক্রেতাদের কাছ থেকেই পেয়েছেন এ নাম। তার খাবার টাঙ্গাইলসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে ডেলিভারি দিয়ে থাকেন তিনি। এটাকে এখন আরও প্রসারিত করার চিন্তা তার।

মাহবুবা খান জ্যোতি বলেন, আমি ছিলাম সংসারী বউ ও এক মেয়ের মা। অবসর সময় ফোনেই কাটতো বেশি। ২০২০ সালের জুন মাসে জয়েন হই উইতে। সেখানে লাখপতি-লাখপতি এসব কথার ছড়াছড়ি। আর একটি নাম ‘রাজীব স্যার’। কোনো কৌতূহল নয় শুধু ‘রাজীব স্যার’কে জানার জন্যই ঘাটাঘাটি করছিলাম গ্রুপটিতে। তার প্রতিটি লেখায় পেয়েছিলাম অনুপ্রেরণা।
জ্যোতি বলেন, উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। আমার স্বামী বর্তমানে মেরিনার ইন্টারন্যাশনাল শিপে কর্মরত আছেন।

পেশাগত দিক থেকে আমার তিনি ছুটিতে এসেছিলেন দেশে। মহামারি করোনার জন্য আটকে যান। অভাবের মুখটা তখন দেখতে পাই। ইচ্ছা না থাকলেও স্বামীর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। দুঃখের ভাগীদার হতে চেয়েছিলাম। লাখপতি হওয়ার জন্য কাজ করিনি। নিজের কাজের ১০০ ভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।

তিনি বলেন, তবে স্বপ্নটা ছিল বিশাল। অনেকে কটুকথা বলেছেন। আচার সেল, কে খায় আচার? মানুষ কিনে খায় এসব? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দেইনি তখন। জবাবটা হয়তো আজ আমায় দেখে তারা বুঝতে পারেন। মাত্র ৪৩ দিনে পুরো আচার ও আমসত্ত্ব বিক্রি করে লাখপতি হয়ে গেছি।

তিনি আরও বলেন, আমি টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসায় করা পছন্দ করতাম না। টাকা দিয়ে টাকা আনায় বিশ্বাসী ছিলাম। বাসায় স্বামীকে খাওয়ানোর জন্য আচার করেছিলাম। আর সেই ছবি ফেসবুকে দেই। আর সেখান থেকেই অর্ডার পাই বেশ কয়েক ধরনের আচারের।

জ্যোতি বলেন, প্রথম অর্ডার ছিল ২৬০ টাকার, যেটা আমার স্বামী ডেলিভারি দিয়েছিলেন। টাকাটা আমার হাতে দেওয়ার আগে বলেছিল, ‘তোমার অনেক কষ্টের টাকা’। টাকাটা আমি হাতে নিয়ে বলেছিলাম, ২৬০ টাকা থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার যেদিন করতে পারবো, সেদিন মনে শান্তি পাবো। টার্গেট পূরণ করতে দুই মাস লেগেছিল।

নিজের কাজের পেছনে পাওয়া উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরু থেকেই আমার স্বামী ও মা অনেক সাপোর্ট করেছে। পরিবারের সবাই বিপক্ষে থাকলেও মা ও আমার স্বামী পাশে ছিলেন। আমার স্বামী ছিলেন আমার ভরসার জায়গা। যার উৎসাহ আর সহযোগিতায় আমি আজ এ পর্যায়ে।

উদ্যোক্তা হওয়াটা কতটা সহজ মনে হয় আপনার কাছে, বা একজন নারীর উদ্যোক্তা হতে কী কী যোগ্যতার প্রয়োজন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মোটেও সহজ নয় এটি। একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে মনের সাহসটা থাকতে হয় সব থেকে বেশি। শরীরের জোরের চেয়ে এ কাজে মনের জোরটা বেশি প্রয়োজন। অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। একজন নারী হয়ে উঠতে পারেন আরও অনন্য, যদি তিনি কাজটাকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, এটা চ্যালেঞ্জের একটা বিষয়। অনলাইনে ১০ জন কী কাজ করছে, সেটায় ফোকাস না করে ১০ জন কী কাজ করতে লজ্জা পান, সেটাই আগে খুঁজে বের করা উচিত। সেটাই আমি করেছিলাম। খাবার নিয়ে কাজ করতে সবাই লজ্জা পায়, সেই সুযোগটাই আমি নিয়েছি। লজ্জা নয়, মনের খুশিতে আমি কাজ করে গেছি। প্রায় ১০-১২ টা দেশে আমার বানানো আচার ও আমসত্ত্ব ডেলিভারি দিতে পেরেছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় আমার এ আচার আইটেম পৌঁছে দিতে চাই।

নিজের সুদূরে প্রসারী ভাবনা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের সন্ধানে’ নামটা একটা ব্র্যান্ড হবে। একটা সময় আমি শতজনকে যেন কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিতে পারি। আমি খাবার নিয়ে কাজ করবো, বিষয়টি আমার স্বামী মন থেকে মেনে নিতে পেরেছিলেন। আমার স্বামী বলেছিলেন, তুমি যদি একটা কয়লা নিয়েও কাজ কর, সেটাও বিক্রি হবে। সে অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে এটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। হয়তো আমার কাজটা লজ্জার মনে হতো। যদিও আমি বর্তমানে তা ভুল প্রমাণিত করতে পেরেছি। এখন পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। কাজে সবাই সহযোগিতা করে।

জ্যোতি আরও বলেন, আমি এখন মাঠ পর্যায়ে গিয়ে প্রথমে ১০টা ঘর নির্দিষ্ট করবো। সেখানে গিয়ে দেখবো কে কাজ করছে, আমাদের বয়সী যারা কাজ করতে আগ্রহী তাদেরকে উৎসাহিত করবো।

(এসএএম/এএস/মার্চ ১৩, ২০২৩)