দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশীদেশ ভারতের অবদান অসীম। এ অবদান কোনক্রমেই অস্বীকার করা উপায় নেই। ভারতের অবদানে কথা উল্লেখ না করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব না। ভারতের অবদান রয়েছে আশাতীত। আর এ অবদান অস্বীকার করলে নিজেদেরই আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে সমস্ত গ্রন্থ লেখা হয়েছে তাতে ভারতের অবদান সর্ম্পকে তেমন উল্লেখ করা হয়নি। কোথাও কোথাও সামরিক সাহায্য, রাজনৈতিক সাহায্যের কথা বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এ সাহায্যের পেছনে অনেকেই ভারতের নানাবিধ ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভারতের সাহায্য এবং অবদান- এর সামগ্রিক দিক কখনো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়নি। তুলে না ধরার পেছনে রয়েছে বিশেষ একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব। 

ইংরেজ বিদায়ের পর থেকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আমলা এবং সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে মৌলবাদী ভাবধারায়। যার জন্য সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা ও সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা তাদের মন-মানসিকতাকে আকড়ে ধরে আছে। যে কারণে আমলা ও সামরিক বাহিনীর অনেক লোকজন এবং রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করলেও তাঁদের মন-মানসিকতা থেকে পাকিস্তানি ভাবধারা নয় মাস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরও দূর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তাঁরা ভারতীয় সাহায্যের ভিতর মতলব অনুসন্ধানে চেষ্টা করেছে। আবার সাহায্য কম হলে কিংবা ভারত স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছে এ নিয়ে বহু সমালোচনা করেছে।

অকৃতজ্ঞরা স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে ভারত বিরোধিতার নাম করে সাম্প্রদায়িক প্রচারনায় অংশ নিয়েছে। এরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সংগে যোগাযোগের ষড়যন্ত্র করেছে। তাঁরা প্রচার করার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করে মুক্তিযুদ্ধ বিরতি দেয়নি বলে। তাঁরা যোগাযোগ করেছে আমেরিকা ও চীনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ করে ফেলার জন্য। কিন্তু কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে ছিল মুজিব নগর সরকার। স্বাধীনতার বিরোধীরা স্বাধীনতার পর অনেকটা সফলতা অর্জন করেছে। এসব কারণেই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বা ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে নানা বির্তকের সৃষ্টি করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সঠিকভাবে তুলে না ধরে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

১৯৯৫ সালে সারা ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে। এক বছর ধরে তার প্রস্তুতি নেয়া হয়। মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সারা বিশ্ব থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তাঁদের সম্বর্ধণা দেয়া হয়েছে। টেলিভিশনে তাঁদের স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর পরও মিত্রবাহিনীর বীর সেনাদের এবং নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠণ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী ও মুজিব জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন করেছে। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। সরকারীভাবে সামরিক মহড়া, কুচকাওয়াজ, জেলখানা, হাসপাতালে ও এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে শিখা চিরন্তন সারাদেশে ঘুরান হয়েছে এবং শিখা চিরন্তন স্থাপন করেছে রাজধানী ঢাকা পাকিস্তানি হানাদারদের আত্ম সমপর্ণ স্থান চিরন্তন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

সরকারী বা বেসরকারী কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, যাদের সাহায্য ছাড়া বিজয় অর্জন ছিল অনিশ্চিত, তাদের অবদান স্মরণ করার কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনী যেসব সদস্য নিহত হয়েছে তাঁদের অবদান সরকারি বা বেসরকারিভাবে যথাযথ ভাবে স্বীকার করা হয়নি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই তাঁদের আলোচনায় বলেন- “মুক্তি যুদ্ধে ভারতের অবদানকে অস্বীকার করাটা হবে চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক।”বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতের বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। যেমনি তাকে আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে, তেমনি লোকক্ষয়ের দিক দিক দিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতের গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।

২৬ শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্ম সমর্পন দিবস থেকে ১৬ ডিসেম্বর’৭১ পযর্ন্ত প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার অসহায় বাঙালী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধর্মের অনুসারীই ছিল। প্রায় এককোটি শরণার্থীর লালন-পালনের জন্য ভারত সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৫০কোটি টাকা বিভিন্ন দেশ ভারত ও মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য দিয়েছে। শরণার্থীদের লালন- পালন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহসহ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হয়েছে আরো বহু টাকা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রায় দেড় হাজার অফিসার ও জওয়ান নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮ জন অফিসার, ৬০ জন জুনিয়র কমিশন অফিসার এবং ১,২৯৩ জন অন্যান্য স্তুরের। আহত হয় ৪,০৬১ জন এবং নিখোঁজ হয় ৫৬ জন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য মূল কৃতিত্বের দাবিদার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ঐ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধান ছিলেন। তাঁর দূরদর্শীতা ও অসীম প্রজ্ঞার জন্য বাংলাদেশের দুঃসময়ে এসে পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। তিনি সেদিন বিশ্বের বড় বড় শক্তিকে ভয় না করে সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সফলতার জন্য অগ্রসর হন।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবদান অসীম। তাঁর এবং তাঁর সরকারের সাহায্য না পেলে আরো কতদিন, কত বছর বাংলার মানুষকে রক্ত দিতে হত তা কল্পনা করতেও ভয় হয়।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে নৈতিক, পরে পরোক্ষ এবং সর্বশেষ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শ্রীমতি গান্ধী এবং তাঁর সরকারের কি ভূমিকা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর অবদান অনস্বীকার্য এবং কেউ যদি তাঁর অবদান গৌন বা প্রকৃত নয় বলে মনে করেন তাহলে তিনি ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসকে অস্বীকার করার এবং বিকৃত করার একটা প্রবণতা আছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করা এবং সাহায্য করা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূন অধ্যায় ছিল। আর ও সংকট মোকাবিলা করার মতো প্রজ্ঞাবানসম্পন্ন দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন শ্রীমতি গান্ধী। তিনি এবং তার সরকার যে ধরনের সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেন তার নজীর বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিন বিশ্বের বহু শক্তিশালী দেশ তাঁর বিরোধিতা করেন। তিনি এককভাবেই তাঁর নীতি গ্রহণ করেন এবং বৃহৎ শক্তির উপর নির্ভরশীল না হয়ে এক সংকটময় ইতিহাসের সফল সমাপ্তি ঘটান। তাঁর আগে এ ধরনের ভূমিকা গ্রহণের মতো সাহসী রাষ্ট্র প্রধান অবশ্য বিশ্বে আর দেখা যায়না। যদিও ১৯৫৬ সালে মিসরের নাসের এবং ১৯৬১ সালে কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো বিশ্ব শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সেটা অবশ্য ছিল তাদের নিজ নিজ দেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভেীমত্বের জন্য। কিন্তু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে করেন প্রতিবেশী ভিন্ন দেশের জন্য। তিনি করেন প্রতিবেশী দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সফল করার জন্য। ভারত সরকার শরণার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করতে পারতো এবং যুদ্ধের ঝুঁকি নাও নিতে পারতো। কিন্তু মানবতাবাদী ও গণতন্ত্রের পুজারী শ্রীমতি গান্ধী তা করেননি। মানবতার সেবক এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আমরণ সংগ্রামী নেত্রী শ্রীমতি গান্ধী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবতাবোধকেই সবার উপর স্থান দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি গান্ধী এবং তাঁর সরকার বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিশ্বের দরবারে যুক্তিযুক্ত করে তুলে ধরেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হন সামরিক পদক্ষেপের দিকে। শ্রীমতি গান্ধী প্রথম থেকেই বাংলাদেশের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করার কথা বলেছেন। কিন্তু পাক সরকার তা করেননি। যার জন্য তাঁকে সামরিক অভিযান চালাতে হয়। তাঁর নির্দেশেই ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে কাঁধে কাধ মিলিয়ে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং বাংলার মাটি ও মানুষকে হানাদার মুক্ত করেছে। আবার তাঁর নির্দেশেই ভারতীয় সেনারা ১২ মার্চ’৭২ বাংলার মাটি ছেড়ে চলে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি ইন্দি রা গান্ধীর ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে অবশ্য কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করতে হয় যাঁরা তাঁর সহকর্মী হিসেবে গুরু-দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি.ভি.গিরি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সরদার শরন সিং, অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি. চ্যাবন, প্রমূখ। এছাড়াও শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ, অটল বিহারী বাজপেয়ী, শ্রীমতি গান্ধীর উপদেষ্টা ডি.পি.ধর, পি.এন, হাকসার টি.এন.কাউল, জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি শ্রী সময় সেন। আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী লক্ষ্মীকান্ত ঝা, পশ্চিমবাংলা মুখ্যমন্ত্রী শ্রীঅজয় মুখার্জী, পশ্চিবাংলার বিরোধী দলীয় নেতা শ্রী জ্যেতিবসু, আরো উল্লেখ করতে হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ, পূর্বাঞ্চলে কমান্ডার লেঃ জেঃ জগজিং সিং অরোরা,ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল এন. কৃষ্ণ, লেঃ জেঃ টি এন, রায়না লেঃ জেঃ সাগত সিং, লেঃ জেঃ এম.এল. থাপান, মেঃ জেঃ জি.এস.গি, মেঃ জে.জ্যাকব, মেঃ জেঃ গন্ধর্ব নার্গর্ ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবর্জী প্রমুখ।

ভারতের জন সাধারণ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সহযোগীতা করেছেন। আমরা ভারতের কাছে চির কৃতজ্ঞ । আমি ২৩ জুলাই’৭১ ৬ শ্রাবন ১৩৩৮ শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গিয়ে ছিলাম। আমি আমার ক্ষুদ্ধ পরিসরে স্বচোখে মুক্তিযোদ্ধা,শরণার্থী ও অন্যান্য সব দেখেছি ও শুনেছি।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।