প্রসেনজিৎ বিশ্বাস : রবিবার মতুয়া সম্প্রদায়ের পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণাঅবতার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১২ তম আবির্ভাব তিথি। প্রায় ২১২ বছর আগে ওড়াকান্দির নিকটবর্তী সাফলা ডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হরিচাঁদ ঠাকুর। বর্তমানে শুধুমাত্র  বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মতুয়া ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। বিগত কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাশ্চাত্য দেশে ভাইরাল হয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাম ভুল উচ্চারণের ক্ষেত্রে, বাংলায় ও তার বিক্ষোভ প্রতিবাদ দেখা গেছে।বর্তমান যাই হোক না কেন, বাস্তবিক, দলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের ত্রাণকর্তা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হরিচাঁদ ঠাকুরের কৃতিত্ব বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৈষ্ণবভক্ত যশোবন্ত ঠাকুর ও অন্নপূর্ণা দেবীর সন্তান হরিচাঁদ জন্মেছিলেন বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণে। অনেকেই তাঁকে গৌতম বুদ্ধ ও চৈতন্যদেবের অবতার হিসেবে মনে করেন। সাদামাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হরিচাঁদ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ পাননি, ভরসা করতে হয়েছে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার পর্যায়ক্রমে। হিন্দু, বৌদ্ধশাস্ত্র, দেশীয় চিকিৎসা, ভূমি ব্যবস্থাসহ একাধিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। অবতার পুরুষ হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ হয় এবং অচিরেই তার ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। হরিভক্তদের মতুয়া বলার প্রচলন হয় এবং ওড়াকান্দি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই ওড়াকান্দি বর্তমানে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় প্রতি বছর।শ্রীমৎ স্বামী তারক চন্দ্র সরকার লিখিত শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত সমস্ত গ্রন্থে নির্যাস হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

মতুয়া সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শন। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান ছিল অন্যতম লক্ষ্য। প্রচলিত ধর্ম শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করে তার বক্তব্য ছিল যে বাহুল্য-সর্বস্ব ধর্মচর্চা অসাড়। 'হাতে নাম মুখে কাজ' - এই মূলমন্ত্র সঙ্গী করে তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আশু উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিলেন জীবনভর। বিবিধের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে জীবনাবসানের পূর্বে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে।

পরবর্তীকালে, পিতার দেখানো পথেই গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের অবহেলিতদের একত্র করেছিলেন। তবে একথা না বললেই নয়, হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তার পুত্র দুজনেই শুধুমাত্র হিন্দু সমাজের নমঃশূদ্রদের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তেলি, মালি, মাহিষ্যসহ সকল সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করে গেছেন। মতুয়া ভাবাদর্শ প্রচারের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। দলিত সমাজের মানুষ হয়ে নিজের পিতার স্বপ্নপূরণ করে বর্ণহিন্দুদের জন্য ১৮৮০ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ওড়াকান্দিতে প্রথম স্কুল স্থাপন করেন এবং ১৯০৮ সালে সরকারি সহায়তায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে রূপান্তরিত হয় সেটি। বর্তমানে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন যা ধর্ম, কর্ম, জ্ঞান প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

নিজের সময়ে বর্ণহিন্দু তথা নমঃশূদ্র মানুষদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দেখে যেতে পারেননি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর। কিন্তু সময় বদলেছে, এসেছে সুযোগও।

(পিবি/এএস/মার্চ ১৮, ২০২৩)