মোহাম্মদ ইলিয়াছ


নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হলে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। পণ্যের বাজার যাতে যখন তখন অস্থির হতে না পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নানা কৌশলে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির করে তোলে। সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকলেও বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।

একদল ব্যক্তি বা কোম্পানি সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে পরস্পরের স্বার্থ সুরক্ষায় একত্রে কাজ করে সিন্ডিকেট তৈরি করে। ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে এ দেশের জনসাধারণ নিত্যপণ্য ক্রয়ে উচ্চমূল্যের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যের জন্য ব্যবসায়ীদের রয়েছে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেশনের ফলে যেসব নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে জনসাধারণ উচ্চমূল্যের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো চাল, চিনি, ভোজ্য তেল, গুঁড়াদুধ, ইলিশ মাছ, মাংস, ডাল ও শাকসবজি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বরাবরের মতোই গতানুগতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাজারে মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে সব ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিলে আর কমাতে চান না। এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ রয়েছে, এক. বাজার মনিটরিং নেই, দুই. বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। মাঝেমধ্যে কিছু মোবাইল কোর্ট বের হয়। কিন্তু এটা বাজারে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। নিত্যপণ্যে দর নিয়ন্ত্রণে তদারকি জোরদার করার বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা যেন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে একচেটিয়া প্রভাব না ফেলতে পারে, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে। নিজেদের সক্ষমতা থাকলে অসাধু চক্র সুযোগ নিতে পারবে না।

বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে সেটি কমার উদাহরণ নেই। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। নিয়মিত বাজার তদারকি ও অভিযান পরিচালনার বিষয়টি সরকারের তরফে নিশ্চিত করা জরুরি। বড় আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকে। মুক্তবাজারে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজারের ওপর সরকারের নজর থাকতে হবে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষকে ঠকাবে। সরকার এটা হতে দিতে পারে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর মধ্য দিয়ে জনভোগান্তি তৈরি করা এই ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে এটা নিশ্চিত করা জরুরি।

এ ছাড়া সরকারবিরোধী কিছু স্বার্থান্বেষী মহল মাঝেমধ্যেই বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ সংকট সৃষ্টি বা মূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে এক শ্রেণির ভোক্তা আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে মজুত করছেন। এ ধরনের প্যানিক বায়িং নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়।

বিশ্বজুড়ে সংকটে আছে। চাহিদার বেশিরভাগ পণ্য আমদানিমুখী হওয়ায় তার সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশেও আছে। অর্থাৎ একটি খারাপ পরিস্থিতিতে সবারই উচিত নাগরিক দায়িত্ব পালন করা। সেটি না করে কেউ যদি খারাপ পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলো নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিকল্প দেশগুলো থেকে অধিক মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়ে বাধ্য হচ্ছে। করোনার অর্থনৈতিক অভিঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দেশের বাজারেও খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক এবং মূল্য

সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্টদের বেগ পোহাতে হচ্ছে। তদুপরি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, অনৈতিক প্রতিযোগিতা, কালোবাজারি ও অবৈধ মজুতদারি যুক্ত হওয়ায় স্থানীয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়ে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠছে। দ্রুত বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা স্বাভাবিক এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন।

সংকট মূল কারণ হলো :অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, সিন্ডিকেট, দাম বৃদ্ধির অনৈতিক প্রতিযোগিতা, কালোবাজারি ও অবৈধ মজুতদারি বন্ধে কঠোর আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। পণ্য আমদানি ও বিপণনে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনিকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ও আখ থেকে চিনি উৎপাদনের হার বৃদ্ধি। প্যানিক বায়িং বন্ধ করতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি। সার, বীজ, কীটনাশকসহ সব কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। বাজারে পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ রাখতে জিটুজি পদ্ধতিতে পণ্য আমদানি এবং বিকল্প রপ্তানিকারক দেশ অন্বেষণ। উৎপাদক বা আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি ধাপে নজরদারি বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ।

কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য আড়তদার, পাইকার, প্রক্রিয়াজাতকারী, ফড়িয়া, খুচরা বিক্রেতা থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ। সরকারের চলমান ওএমএস কার্যক্রম আরও জোরদার করতে সারা দেশে কেন্দ্রসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ। মিলকারখানাগুলোর পূর্ণ সক্ষমতায় সচল রাখা এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য আমদানি নিশ্চিতকরণ। শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করে উৎপাদন বৃদ্ধি। নজরদারি বৃদ্ধি ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডলার পাচার রোধ। ডলারের অবৈধ মজুত ও কালোবাজারি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাগবের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর ও সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।