স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ : সম্মেলনের পাঁচমাস অতিবাহিত হলেও ঘোষনা করতে পারেনি ঝিনাইদহের  শৈলকূপা উপজেলা ও পৌর আওয়ামীলীগের কমিটি। পদ পদবী দখল করতে একাধিক দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিতরা জেলা  ও  কেন্দ্রে দৌড়ঝাপ করছেন বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই-বাচাই পূর্বক  পারিবারিক ভাবে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ও ক্লীন ইমেজের ব্যক্তিদের পদ-পদবী দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে তারা দলীয় সভানেত্রী ও সাধারন সম্পাদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, শৈলকূপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করতে ধলাহরাচন্দ্র ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান ব্যাপক ভাবে দৌড় ঝাপ শুরু করেছেন। মতিয়ার এরশাদের আমলে জামায়াতি ইসলামের ভোটে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। ১৯৯৭ সালে ইউপি নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির ভোটে ধলাহরাচন্দ্র ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেই থেকে উত্থান ঘটে মতিয়ারের। জড়িয়ে পড়েন একের পর এক অনিয়ম দুর্নীতিতে। মতিয়ার রহমান তার চাচাতো ভাই কলিমুল্লাহ শৈলকূপা ডিগ্রী কলেজ শাখার ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারী ও আরেক ভাই রুহুল আমিন ইউনিয়ন জামায়াতের নেতাকে নিয়ে আয় করেন কোটি কোটি টাকা। এরপর তাদেরকে সাথে নিয়ে ওই ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের প্রবীন নেতাদের মারধোর করে পঙ্গু করেছেন। সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে নান্নু এবং ইউনিয়নের ধাওড়া গ্রামের মহাসিন শিকদার এবং বিভিন্ন এলাকার খবির মেম্বার, জাকির হোসেন ও সাইফুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যক্তির বাড়ি ঘর ছাড়া করেছেন। তার গোন্ডা বাহিনী দিয়ে জমি দখল ও সরকারি গাছপালা বিক্রি করে নিয়েছেন।

মতিয়ার পুত্র দিনার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ পাওয়ার পর থেকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির হার আরো বেড়ে যায় ওই এলাকায়। শুরু করেন বিভিন্ন কাজের টেন্ডারবাজি,হাট-বাজার ইজারা,ইউনিয়ন পরিষদের টিআর, কাবিখার প্রকল্পের দুর্নীতি ও বিভিন্ন প্রকার ভাতার কার্ডে অনিয়ম এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পারিবারিক ভাবে সভাপতির পদ দখল করে নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে মতিয়ার নৌকা প্রতিকের বিরুদ্ধে ভোট করেন এবং তার ইউনিয়নে নৌকা প্রতিকের পক্ষে কোন পোলিং এজেন্ট দিতে দেওয়া হয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মার্কা আনারস প্রতিকে জোরপূর্বক ভোট কেটে নেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। তার পুত্র দিনার নিজ দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে হিন্দুদের প্রতিমা ভেঙ্গে পুলিশকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আশিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জেলার সাংবাদিকদের অবগত করেন। ইউনিয়নের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ প্রবীন আওয়ামীলীগের নেতা সকলেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার পরিবারের দ্বারা। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।

অপর দিকে সাধারন সম্পাদকের পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এম আব্দুল হাকিম আহমেদ ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম হোসেন মোল্লা। ২০১৫ সালে টেন্ডারবাজি করতে না পেরে প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন মৃধা ও তার ছেলে সাজন মৃধাকে শৈলকূপা হাসপাতাল গেটের সামনে থেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারাত্বক জখম করা হয় তাদের দুজনের নেতৃত্বে। বাবা ও ছেলে দুইজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকে। ওই সময় নির্যাতনের ভিডিও পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নজরে আসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি নিজে সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় এম আব্দুল হাকিম আহমেদ ও শামীম মোল্লাকে আসামী করে শৈলকূপা থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

এ কারণে শামীম হোসেন মোল্লাকে শৈলকূপা যুবলীগের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। দুজনেই অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে টেন্ডারবাজি করে উপজেলার প্রায় সব ঠিকাদারী কাজগুলো নিজেরা বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার কাজের মান একাবারেই নিম্নমানের। কেউ প্রতিবাদ করলেই শিকার হতে হয় ভয়াবহ নির্যাতনের। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি বর্তমান উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নিলুফা ইয়াসমিনসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ একাধিক ঠিকাদার। এ বিষয়ে অনেকবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোন সুরহা পাননি ভুক্তভোগীরা। এম আব্দুল হাকিম আহমেদ ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও স্থানীয় এমপি আব্দুল হাই'র আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে বনে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা।

এদিকে মোল্লা পরিবারও উমেদপুর ইউনিয়নের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ দখল করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকার ফান্ডের টাকা জোর পূর্বক তুলে নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। ২০১৬ সালের পৌর নির্বাচনে, ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে ফের ২০২১ সালের পৌর নির্বাচনে ও ২০২২ সালের উপজেলা উপ-নির্বাচনে নৌকা প্রতিকের বিরুদ্ধে জোরেসোরে ভোট করেন।

২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে তার নিজ ইউনিয়নের অধিকাংশ কেন্দ্রেই নৌকা প্রতিকের পক্ষে পোলিং এজেন্ট দিতে দেওয়া হয়নি। বরং স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট কেটে দিয়েছে তার প্রমাণ ভোটের ফলাফল দেখলেই বুঝা যাবে। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি সংখ্যালঘু পরিবাররাও। কবিরপুর মোড়ে অনেক পুরাতন মন্দির ভেঙ্গে জোরপূর্বক রাতারাতি মার্কেট করেছেন। সে কারণে আদালতে একটি মামলাও চলমান রয়েছে। সম্পূর্ন জমির বৈধতা না থাকার কারনে বিদ্যুৎ বিভাগ এই মার্কেটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়নি।

অভিযোগ রয়েছে উমেদপুর ইউনিয়নের অনেক হিন্দু গ্রামের বাসিন্দাদের জোরপুর্বক জমি দখল করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সামাজিক কোন্দলের কারণে মারামারি সৃষ্টি হলেই নিজেদের লোক নিজেরাই খুন করে প্রতিপক্ষকে দমাতে মামলা করে বাড়ি ছাড়া করা হয় তাদের। প্রতিপক্ষের জমাজমি দখলপূর্বকসহ গাছপালা কেটে নেওয়া হয়। সেই সাথে লুটপাটসহ বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই আদায় করে মোটা অংকের টাকা। শামীম হোসেন মোল্লার পিতা সাব্দার হোসেন মোল্লা তৎকালিন মুসলীমলীগ তথা রাজাকার পরিবারের সদস্য ছিলেন বলে এলাকায় চাওর রয়েছে। তিনি যখন যে দল ক্ষমতায় আসেন তখন সেই দল করেন। ১৯৭৯ সালে জাসদ গণ বাহিনীর সদস্য ছিলেন সাব্দার হোসেন মোল্লা। ১৯৮৬সালে জাতীয় পার্টির শৈলকূপা থানা কমিটির নেতা ছিলেন।

১৯৯১সালে বিএনপিতে যোগদান করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়ে কোটিপতি বনে যান। ক্ষমতার প্রভাবের কারণে তিনি শৈলকূপার সাবেক ইউএনও আজমল হক,ঝিনাইদহ চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তার ও ঝিনাইদহ মৎস্য কর্মকর্তাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে মারধোর করেন। লেখাপড়া না জানলেও ২০১৩সালে ডিগ্রী পাস দেখিয়ে মিয়া জিন্নাহ আলম ডিগ্রী কলেজের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন তিনি। এরপর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে ব্যাকডেটে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এব্যাপারে ঝিনাইদহ আদালতে দুইটি মামলা চলমান রয়েছে।

এছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে নেয়। সেই সাথে কলেজের দামি বনজ গাছপালা কেটে বিক্রি করে নিয়েছেন। এ সব ঘটনা পুনরায় নিয়ন্ত্রনে রাখতে নিজ কন্যা ও সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধী ডাক্তার জাকির হোসেনের স্ত্রী মেরিনাকে সভাপতি করে রেখেছেন কাগজে কলমে।

এ সকল বিষয় অস্বীকার করে মতিয়ার রহমান,এম আব্দুল হাকিম আহমেদ ও শামীম হোসেন মোল্লা জানান, আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটা করে প্রতিপক্ষদের বেশি লাভ হবে না। শৈলকূপার প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা অধ্যাপক আবেদ আলী জানান,জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল হাই এমপির কারনেই এধরনের হাইব্রীড নেতারা বিগত সময়ে দলীয় বড় পদ বাগিয়ে নিয়ে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন। এদের হাত থেকে দলীয় নেতাকর্মরাও রেহাই পাচ্ছে না। তারাও নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের স্বীকার হচ্ছে। এখনি যদি কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড শৈলকূপায় নজর না দেয় তাহলে ত্যাগী নেতাদের অবস্থা হবে আরো ভয়াবহ।

জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার জানান, আব্দুল হাই যখন যা মন চাই তখন তাই করেন। তার হাত ধরেই উথ্থান হয়েছে মতিয়ার রহমান, সাব্দার হোসেন মোল্লা ও শামীম মোল্লার মতো নেতার। এরা ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করে এককছত্র ভাবে শৈলকূপা নিয়ন্ত্রণ করছেন। পুনরায় এরা যদি পদ-পদবী পান তাহলে শৈলকূপা ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হবে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু জানান, বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছে জানানো হয়েছে। দেখা যাক তারা কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে।

(একে/এএস/মার্চ ২৯, ২০২৩)