চাঁদপুর প্রতিনিধি : ইলিশ রক্ষায় অভিযান শেষে মাছ ঘাট এলাকায় ধুম পড়েছে ইলিশ কেটে লবণ দেয়ার। দিনরাত কাজ করছে শ্রমিকরা। এ যেনো এক মহোৎসব।

ইলিশের রাজধানী চাঁদপুর। সে রাজধানীতেই গত ক’দিন পূর্বে ছিলো ইলিশের আকাল। বেকার ও অলসপূর্ণ সময় কাটিয়েছে মাছ ব্যবসায়ি থেকে শুরু করে এ ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক কর্মচারীগণ। তখন সবার মুখেই ঘুরে ফিরে একটি কথাই শোনা গেছে, ইলিশ শূন্য হয়ে পড়েছে চাঁদপুরের নদী। মা ইলিশসহ জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ না করতে পারলে রূপালী ইলিশের দেশ চাঁদপুরের ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

ইলিশ ধরা বন্ধ করতে হলে চাই গণসচেতনতা বৃদ্ধি। এ গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে চাঁদপুরে গত ৬ বছর ধরে আয়োজন করা হয় ইলিশ উৎসবের। আয়োজকদের একটাই লক্ষ্য ছিলো জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু এতো আয়োজন সত্ত্বেও জেলে পরিবার থেমে থাকেনি। তারা প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালেও অবাধে নিধন করেছে ইলিশ। এ নিধন প্রক্রিয়ায় মা ইলিশ আর বাচ্চা ইলিশ কোনোটিই রক্ষা পায়নি।

অবশ্য এবার অভিযান চলাকালে প্রশাসনের কার্যক্রম অন্যান্যবারের চেয়ে অনেকটাই ছিলো শক্তিশালী। এবার অভিযানে শুধু জেলেদেরকেই ধরা হয়নি, প্রয়োজনবোধে ধরা হয়েছে সাধারণ ক্রেতাদেরকেও। যারা খাওয়ার জন্যে মাছ কিনতে গিয়েছেন তাদের কাউকে কাউকে আটকের সংবাদে মানুষের মাঝে অভিযান চলাকালীন মাছ কেনার প্রবণতাও কিছুটা কমেছে। যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কিন্তু এ ভালো দিক অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে যখন অভিযান শেষে ভোলা, বরিশাল, লালমোহনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ’শ ট্রলার চাঁদপুর মাছ ঘাটে এসে পৌঁছেছে।

গত ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর ছিলো চাঁদপুরের মেঘনায় মাছ ধরা বা বিপণন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, প্রশাসনের এ উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিয়েছে কিছু অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ি। তারা ১১ দিনের অভিযান চলাকালীন সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলসহ নদ-নদীতে বিপুল পরিমাণ ডিমওয়ালা ইলিশ নিধন করে। অভিযান চলাকালীন নিয়ম ভঙ্গ করে অবৈধভাবে ধরা এসব ইলিশ তারা তখন আর চাঁদপুর ঘাটসহ অন্য স্থানে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। পারেনি প্রয়োজনীয় বরফ সংগ্রহ করতে। তবে অভিযানের সংবাদে অনেকেই আগেভাগে বরফ সংগ্রহ করে রাখলেও তার পরিমাণ কম থাকায় যে পরিমাণে মাছ ধরা পড়েছে সে পরিমাণে বরফ দিতে পারেনি।

এই কারণে দীর্ঘ ১১ দিনের অভিযানে ধরা পড়া মাছ বরফের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যা অনেকটাই খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। দেখা যায়, অভিযান চলাকালীন এ সকল মাছ ধরে রেখে বর্তমান সময়ে অভিযান উঠে যাওয়ার পর সকল মাছ বিক্রি করার জন্য ট্রলার ভর্তি করে চাঁদপুর মাছঘাটে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ সকল পঁচা মাছের গন্ধে বর্তমানে মাছ ঘাটের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। ফিশিং বোটে আনা এ সকল মাছ নিয়ে বিপাকে আছেন ফিশিং বোটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তারা সময় মতো মাছ খালাস করতে না পারার কারণে অস্বস্তিবোধ করছেন। অবৈধভাবে ধরা পঁচে যাওয়া এ মাছ নিয়ে যেমন বিপাকে রয়েছে মালিক পক্ষ, তেমনি বিপাকে রয়েছেন বড় স্টেশন মাছ ঘাটের লোকজন মাছ বিক্রি করতে না পারার কারণে।

অবশ্য এক শ্রেণীর মৎস্য ব্যবসায়ি এগিয়ে এসেছেন এ সকল মাছ রক্ষায়। এ মাছ রক্ষায় বড় স্টেশন মাছ ঘাট এলাকায় ধুম পড়েছে ইলিশ কেটে লবণ দেয়ার। মাছ ঘাট এলাকার পরিত্যক্ত রেল লাইন জুড়ে কয়েক স্থানে টানানো হয়েছে তাঁবু। যেখানে দিন-রাত কাজ করছে নারী-পুরুষ শ্রমিকরা। কেউ মাছ ধুয়ে দিচ্ছে, কেউ মাছ কাটছে, কেউ আবার মাছের ভিতর লবণ মিশাচ্ছে। তবে মাছে যে লবণ দেয়া হচ্ছে তা আয়োডিনবিহীন লবণ। এ সকল লবণ মেশানো মাছ আবার সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অভিযানকালীন এ সকল মাছ ধরা হলেও অভিযান শেষ হয়ে যাওয়ায় তা এখন বৈধ। তাই এ সকল বৈধ মাছ যতো খারাপই হোক তা নষ্ট করা যাবে না। যে কোনো উপায়ে তা সংরক্ষণ করতে হবে। আর সে সংরক্ষণ করতেই এখন ব্যস্ত রয়েছে মাছ ঘাটের অধিকাংশ শ্রমিক।

এ ব্যাপারে কথা হয় চাঁদপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিছ আলী গাজীর সাথে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখন যে উপায়ে মাছ কেটে লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হচ্ছে তা কতোদিন টিকে থাকবে এবং এ সকল মাছ খাওয়ার উপযোগী কি না? জবাবে তিনি জানান, এ সকল মাছ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কেটে ভালোভাবে লবণ দেয়া হচ্ছে। লবণ দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলে এ সকল মাছ মাটির নিচে ট্যাংকির ভিতর রাখা হবে। যাতে করে কোনো পোকা-মাকড় মাছে সৃষ্টি হতে না পারে।

বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বনে রাখা এ সকল মাছ ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষণে রাখা যাবে। তবে তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে অনেকেই লোনা ইলিশ খেতে ভালোবাসেন। তাই লবণ দেয়া এ মাছের চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। তবে তিনি যাই বলুন না কেন, লবণ দেয়া এ সকল মাছ খাওয়া কতোটুকু স্বাস্থ্য সম্মত তা মৎস্য বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাগণই ভালো বলতে পারবেন। তবে যে পরিমাণ মাছ বর্তমান সময়ে বড় স্টেশন মাছ ঘাট এলাকায় জমা হয়েছে, সে পরিমাণ মাছই বলে দেয় অভিযানের কার্যক্রম কতোটুকু সফল হয়েছে।

অভিজ্ঞ মহলের অনেকেই মনে করেন, শুধু নির্দিষ্ট কিছু এলাকা জুড়ে মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান দিলে হবে না। অভিযান দিতে হবে বাংলাদেশের সকল জল সীমানা জুড়ে। যাতে কেউই অবৈধভাবে অভিযান চলাকালীন মাছ ধরতে বা কিনতে না পারে। মঙ্গলবার বড় স্টেশন মাছ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমান হালনাগাদ সময়ে ধরা মাছের আমদানি একেবারেই কম। যা রয়েছে অভিযান চলাকালীন ধৃত মাছই। যা বিক্রি হচ্ছে ৩’শ থেকে ৪’শ টাকা কেজি।

(এমজে/জেএ/অক্টোবর ২৩, ২০১৪)