ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুক্রবার ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৩। আন্তজার্তিকভাবে এবং জাতীয় পর্যায়ে দেশে দেশে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়, এর কারণ হচ্ছে জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ এর জন্মদিন ৭ এপ্রিল ১৯৪৮। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার ২ মাস পর ২৪ জুন ১৯৪৮ সালে এই সংস্থার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জেনেভায়। সেই সময় সারা বিশ্বের ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে প্রতি বছর নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর এমন একটি প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে যা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ‘নো ইউর হেলথ সার্ভিসেস’ যার অর্থ ‘নিজের স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। এভাবে ৭২ বছর ধরে ৭ এপ্রিল বিশ্ব জুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় উক্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নিয়ে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক কাজের সাথে সম্পৃক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।

২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। ৭৫ বছর পরে এখন ফিরে দেখার বিষয় এর কতটা পূরণ করতে পেরেছে। জনস্বাস্থ্যের কতটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। গত ৭ দশকে মানুষের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নতি হয়েছে সেটাও দেখার বিষয়। এর সাথে সাথে বর্তমান ও আগামী দিনের জন্য মানুষের স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় কার্যকরী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে যে বিষয়টি সবচাইতে গুরুত্ব দিচ্ছে তা হলো সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বা ‘হেলথ ফর অল’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস কেন পালিত হয়?

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয় স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা ও শিক্ষা প্রচার করার জন্য এবং মানুষকে তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে উৎসাহিত করার জন্য। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাকে স্মরণ করার এবং বিশ্বের জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উপায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস এর স্লোগান

প্রতি বছর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের জন্য একটি থিম বেছে নেয়। থিমগুলি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা বা উদ্বেগের সাথে সম্পর্কিত, এবং সেগুলি সচেতনতা বাড়াতে এবং পদক্ষেপকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস কেন গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস কেন গুরুত্বপূর্ণ তার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। আজকের বিশ্বে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে অনেকগুলি বিভিন্ন স্বাস্থ্য হুমকি রয়েছে যা সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার।

এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে, আমরা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারি যে লোকেরা কীভাবে নিজেকে এবং তাদের পরিবারকে এই হুমকিগুলি থেকে রক্ষা করতে পারে সে সম্পর্কে আরও ভালভাবে অবহিত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজের প্রতি আমাদের সমর্থন দেখানোর একটি সুযোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের প্রচার এবং বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি মোকাবেলায় সহায়তা করার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সমর্থন করার মাধ্যমে, আমরা তাদের সমস্ত কিছুর জন্য আমাদের প্রশংসা প্রদর্শন করতে পারি।স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শারীরিক সুস্থতার নামই স্বাস্থ্য। অসুস্থ শরীর যার, তার পক্ষে সুখ লাভ অসম্ভব। স্বাস্থ্য এক অমূল্য সম্পদ।ভাল স্বাস্থ্যই সুস্থ ও সতেজ জীবনের চাবিকাঠি। এ কথা আমরা ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সাধারণ মানুষের ভাল স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা যেমন দারিদ্র, তেমনই আর একটি প্রধান বাধা সচেতনতার অভাব। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা এমন একটি বিষয়, যার উপর একটি দেশের মানব সম্পদ অনেকাংশে নির্ভরশীল। নাগরিকের সুস্বাস্থ্যের অভাব দেশের উৎপাদনশীলতা কমে, কমে যায় উন্নয়নের গতি। বিশ্ব স্বস্থ্য দিবসের গুরুত্ব এখানেই

আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...
স্বাস্থ্য খাত একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। বলা হয়ে থাকে, যে দেশের জনগণ স্বাস্থ্যের দিক থেকে এগিয়ে, সে দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে গতিশীল।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তাই বঙ্গবন্ধু এ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণাঙ্গ দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণবোধ। শুধু দুর্বলতার অনুপস্থিতিকে স্বাস্থ্য বলে না।আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল উদ্দেশ্য জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে প্রচার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তর অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধি নির্মূল, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়ন, গবেষণা, স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি, মহামারি প্রতিরোধ, শিশুর রোগ প্রতিরোধ, মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিরোধ ইত্যাদি লক্ষ্য বাস্তবায়নে শুরু থেকে কাজ করে আসছে।আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় পদ সৃষ্টি করা হলেও সে অনুযায়ী জনবল নেই, এক হাজার ৫৮১ জন লোকের জন্য রয়েছেন একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক। গ্রামীণ, প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলগুলোতে চিকিৎসক শূন্যতার হার বেশি।

অভাব রয়েছে প্রশিক্ষিত নার্সের। অনেক সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম পাওয়া গেলেও প্রযুক্তিবিদের পদ খালি রয়েছে। জনবল (ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস, ল্যাব-টেকনিশিয়ান) নিয়োগের ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ না করা হলে এ অব্যবস্থাপনার সমাধান হবে না। বিকেন্দ্রীকরণের ধাপ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে নির্ধারিত করতে হবে। শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দিলে হবে না, কর্মস্থলে তাদের ধরে রাখাও জরুরি। শুধু উচ্চ বেতনই চিকিৎসকদের কর্মস্থলে থাকার ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারে না, তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর দিতে হবে। বিশেষ করে নারী চিকিৎসকদের আবাসিক ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন। এমনও অনেক ঘটনা আছে, যেখানে আধুনিক স্বাস্থ্য সরঞ্জাম থাকলেও সেগুলো চালানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে এগুলো পরিচালনার অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং রোগীরা অবহেলায় মারা যায়।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে প্রতিরোধী স্বাস্থ্যসেবা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে প্রতিরোধী স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই গড়ে ওঠেনি। তাই চিকিৎসা-শিক্ষা ব্যবস্থাকে চার ভাগে বিন্যাস করতে হবে। যেমন-ক্লিনিসিয়ান, শিক্ষক, প্রশাসন ও রোগ প্রতিরোধক। এ চার ভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ কার্যপরিধি নির্ধারণ করবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকের রোগী দেখা নিয়ে দেশের মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তারা মনে করে, চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে রোগী দেখেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকরা মনে করে, লোকজন তাদের ঠিকভাবে মূল্যায়ন করে না। রোগীর চিকিৎসা একইসঙ্গে শুদ্ধবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের যৌথ প্রয়োগ। মেডিকেল সায়েন্স হচ্ছে শুদ্ধবিজ্ঞান। কিন্তু যে মানুষটিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সে এবং তার স্বজনদের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত।

আমাদের মেডিকেল শিক্ষা পাঠ্যক্রম এবং প্রশিক্ষণে সমাজমনস্কতা ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘসূত্রতা বেশিরভাগ সময় রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সমস্যা সমাধানে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়ে রোগীরা উপজেলা ও জেলাভিত্তিক ইনডোর স্বাস্থ্যসেবা পেতে ডিজিটাল সুপারিশ পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের জন্য উপজেলা থেকেই জেলা, বিভাগীয় ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সুপারিশ পদ্ধতির মাধ্যমে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের জন্য রোগীদের সেবা ব্যাহত হয়। এ ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা করতে হলে মেরামতের ব্যবস্থার জন্য অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করে দ্রুত সময়ে সব যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে এবং এ ব্যবস্থাকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাসপাতালের পরিবেশ উন্নতির জন্য অপরিহার্য। রোগী এবং রোগীদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কথা চিন্তা করে সে অনুযায়ী টয়লেট ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ ও তদারকির জন্য জনবল জরুরি। হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং তত্ত্বাবধানের জন্য মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এরা রোগীদের সঙ্গে ‘পাবলিক রিলেশনের’ ভূমিকা পালন করবে।

গত ৫২ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’। সত্যিকার অর্থেই দেশে পেশাদার একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় সর্বত্রই একই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, জিডিপির পাঁচ শতাংশের মতো অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। বাংলাদেশে এক যুগের অধিককাল ধরে বাজেটে জিডিপির এক শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও কম-বেশি ৭০ শতাংশ বেতন-ভাতা ইত্যাদির মতো খাতে খরচ হয়। বাকি অর্থ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ব্যবহৃত হওয়ার কথা, যা নিতান্তই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবে এ খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে এ অর্থের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অর্জনগুলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশের জনসাধারণের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো নিরসন করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে তা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে:

১. সব রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি মানবকল্যাণ এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

২. তেল-গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে ব্যবহার করতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি।

৩. WHO-র বায়ু মানের নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করতে হবে।

৪. শরীরচর্চা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে এমন সবুজ স্থান তৈরি করতে হবে।

৫. WHO-র সবুজ ঘোষণাপত্র গ্রহণ এবং অঙ্গীকার করতে হবে।

৬. সব পরিবেশ ধূমপানমুক্ত করতে হবে।

৭. বর্জ্য ও প্লাস্টিক হ্রাস নীতি তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮. শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে।

৯. পাবলিক স্পেসে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয়ের বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

১০. স্থানীয় উত্পাদকদের কাছ থেকে তাজা পণ্য কিনতে হবে এবং উচ্চ প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে।

১১. প্লাস্টিকের বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।

আমরা এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতে চাই এবং যার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস্তবায়ন করতে চাই যেখানে নির্মল বাতাস, পানি ও খাবার সবার জন্য সহজপ্রাপ্য হবে। আমরা এমন একটি অর্থনীতি দেখতে চাই, যা হবে স্বাস্থ্য ও মানুষের কল্যাণনির্ভর। আমরা সব শহর বাসযোগ্য দেখতে চাই, যেখানে মানুষ তাদের স্বাস্থ্য এবং গ্রহের স্বাস্থ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন। এখানে স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু ওষুধ প্রদানকে বোঝায় না।

স্বাস্থ্যসেবা বলতে আরও বোঝায়- ক. সব রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, খ. সম্ভাব্য সব অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনা, গ. মৌসুমভিত্তিক সংক্রামক রোগের সময়োচিত প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, ঘ. জীবনব্যাপী সব মানুষের আদর্শ সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সব প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা।স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ও উদ্বেগগুলির প্রতি সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এটি একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে পালিত হয়, একটি নির্দিষ্ট থিম নির্বাচিত করা হয় সারা বছরব্যাপী স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালানো জন্য।আর দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারী রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর মৌলিক চিন্তা ছিল দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামীণ জনগণের জন্য মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের কিছু পরামর্শ

* একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা নির্বাচন করুন এবং ধীরে ধীরে সেটার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করুন।

* শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ব্যায়াম বা শারীরিক কসরত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিকভাবে কর্মক্ষম এবং সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন।

* নানা ধরনের খাবার খান, তবে সেগুলো যেন স্বাস্থ্যকর হয় সেদিকে নজর দিন। অতিরিক্ত ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করে চলুন। যাতে অযথা ওজন বেড়ে না যায়।

* শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

* কখনো কোনো খাবার বাদ দিয়ে যাবেন না। সময় মতো প্রাতঃরাশ-মধ্যাহ্নভোজ এবং রাতের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। উপবাসে শরীরের ক্ষতি হয়।

* প্রক্রিয়াজাত এবং প্যাকেটজাত খাবার বর্জন করুন। এর মধ্যে উপকারের থেকে বেশি ক্ষতিকারক উপাদান থাকে।

* মৌসুমী সবজি এবং ফল দিনে এক থেকে দু’টো করে খাওয়ার চেষ্টা করুন।

* নুন এবং চিনি খাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখুন। এর থেকে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

* শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখুন।

* দুশ্চিন্তা এবং হতাশাকে দূরে রাখুন। এর জন্য প্রয়োজনে যোগাভ্যাস মেডিটেশন নিয়মিত করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই,সুস্থ জীবনের প্রয়োজন অনুধাবন করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল লক্ষ্য। আমারা আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল নই বিদায় আমরা আমাদের খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম ও কাজের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেই না। আর আমরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি তখনি সুস্থতার অনুধাবন করি। আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে যে, সুস্থতাই একজন মানুষের বড় নেয়ামত।

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান রোগ-ব্যাধির কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।প্রতিবছর নতুন নতুন মহামারি, রোগব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা হয় এবং এই ধরনের মহামারীকে মোকাবেলা করার জন্য একটি থিম তৈরি করে সঠিক স্বাস্থ্য সেবা সকলের জন্য নিশ্চিত করার লক্ষে সারা বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ইভেন্ট এবং সেবার আয়োজন করা হয়।

মানুষের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং আচরণ থেকে মুক্তি পাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত, বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনও অসুস্থতার জন্য ওষুধ খান।

নিজ স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি, এলাকার অনন্যা মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনরাও যেন তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হন সে দিকে লক্ষ্য রাখা। স্বাস্থ্য দিবসের একটি বড় উপাদান হল একটি স্বাস্থকর জীবনধারা এবং আপনার চারপাশের একটি স্বাস্থ্যকর পৃথিবী। যে কোনও স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলুন।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো আটটি দিবস পালন করে থাকে যে আটটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রচার মূলক কাজ করে থাকে, তার অন্যতম হল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। অন্যগুলি হল, বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস, বিশ্ব রোগ প্রতিরোধ সপ্তাহ, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস, বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস এবং বিশ্ব এইডস দিবস।স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ও উদ্বেগগুলির প্রতি সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এটি একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে পালিত হয়, একটি নির্দিষ্ট থিম নির্বাচিত করা হয় সারা বছরব্যাপী স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালানো জন্য।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।