মীর আব্দুল আলীম


রাজধানী ঢাকার পাশে পূর্বাচল খ্যাত রূপগঞ্জ হলো আরেক ঢাকা। রূপগঞ্জের জমি এখন যেন সোনার হরিণ। জমির পিছে ছুটছে সবাই। এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট শহর রূপগঞ্জে অন্তত তাঁদের এক টুকরো জমি থাকাচাই চাই। আর রূপগঞ্জে জমি নিয়ে চলছে নানা কান্ড কারখানা। দখলবাজী অংশ কেনার নামে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম এখন নিত্যদিনের ঘটনা। রূপগঞ্জের প্রতিটি গ্রামের এখন এই চিত্র। কষ্টে প্রতিদিন চোখের জল খসাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কান্না ছাড়া যেন কিছু নেই তাদের। 

সাধারণ মানুষের এই দুঃখ কষ্টের কথা লিখতে হয় রূপগঞ্জে কর্মরত সাংবাদিকদের। সব লিখতেও পারেনা তারা। দলীয় হুমকি ধমকির কাছে হার মানতে যেন সাংবাদিকদের। যতটুকু লেখে তাতে রোষানলে পরতে হয় তাদের। সর্বশেষ চলতি মাসে বাংলা টিভির সাংবাদিক রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য সাহেল কিরণকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার উপর হামলা হয়েছে। কি বর্বরচিত হামলা তা গোটা দেশবাসী দেখেছে। নেক্কারজনক সত্য হলো একটি পক্ষ উল্টো মানববন্ধন সহ সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ঐ সাাংবাদিকের জীবন এখনও সংঙ্কামুক্ত নয়। তার উপর এ হামলার প্রতিবাদে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা আজ পথে নামে। তা এখন সারাদেশের অন্দোলনে পরিনত হয়েছে। সারা দেশের সাংবাদিকরা তাঁর উপর হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

আমরা দেশে কি দেখছি? সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকদের খুন করে; রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের নামে মামলা ঠুকে দেয়। আবার কথায় কথায় রাজপথে সাংবাদিক পেটায়। এ দেশে বরাবরই নানাভাবে হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সন্ত্রাসী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনকি রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সুযোগ পেলে সাংবাদিকদেরও পর ঝাল মেটায়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাউকে ছাড় না দিয়ে একজন সাংবাদিকে ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখতে হয়। আর তাতেই ক্ষেপে যান সংশ্লিষ্টরা। কখনো জীবন কেড়ে নেওয়া, কখনো শরীরিকভাবে হামলা, আবার প্রায়সই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এখন শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, সাংবাদিক খুন হচ্ছে। অপসাংবাদিকরা সাংবাদিকদের জানমালের ক্ষতির কারণ হচ্ছে তাও দেখছি।

প্রশ্ন হলো এভাবে সাংবাদিকরা আর কত নির্যাতনের শিকারহ বেন? দেশে গণমাধ্যমের যে উজ্জ্বল ভূমিকা, তার সঙ্গে সারাদেশের হাজার হাজার সাংবাদিকের ঘাম-শ্রম ও জীবনের ঝুঁকি জড়িত। কিন্তু সাংবাদিকদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবছে কম! দেখছি মৌলভী, মাওলানারাও সাংবাদিকদের পিছু নিয়েছে। তারা সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে কতল (জবাই) করার ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য ওই ইসলামী বক্তা এরই মধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। শুধু আওয়ামীলীগ, বিএনপির সভা-সমাবেশ সংঘর্ষে যেমন টার্গেট সাংবাদিক আজকাল হেফাজতের টার্গেটও সাংবাদিক। সম্প্রতিকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগের দু'পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন। তাকে টার্গেট করেই গুলি করা হয়েছে বলে দাবি ওঠে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে এবং রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে সাংবাদিকরা হামলার শিকার হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের সহিংস কর্মসূচি ঘিরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ২০ জন গণমাধ্যমকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে সাংবাদিকদের এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়, বরং এর প্রবণতা বাড়ছে। এ কথা বলতেই হয় যে, বর্তমানে সাংবাদিক নির্যাতন স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়। অনেক সময় জন প্রতিনিধিদের ছত্র ছায়ায়ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। জেলা উপজেলা পর্যায়ে সেটা বেশি। দেশ জুড়ে প্রেসক্লাব দখল, দলীয়করণ এবং কুক্ষিগত করার ঘটনাও রয়েছে অনেক। সাংবাদিকদের ইচ্ছামাফিক নিউজ করতে বাধ্য করা। কথা না শুনলে নানাভাবে হয়রানি করা। অথচ সরকার এসব ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটি খুবই উদ্বেগজনক। সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে এসব 'সাংবাদিক হামলা-নির্যাতন' বন্ধ করা খুবই জরুরি।

পরিসংখ্যানটি আঁতকে ওঠার মতো। গত দেড় যুগে ৫১ জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৫৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটিতে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনা থেকে শুরু করে সাংবাদিক হত্যাকান্ডের একটি ঘটনার সঠিক বিচার হয়নি। খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকরা নিজেরাই খবর হচ্ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। বাকি আড়াই বছরে আরও অন্তত ১০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এত খুন হয়েছে কয়টা ঘটনার বিচার হয়েছে? একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নানা রকম ভয়ভীতি ও হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সংকুচিত হয়ে উঠছে, অন্যদিকে শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব হামলা-নির্যাতন সাংবাদিকতা পেশাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছেএবং তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে- যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একটা বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে, সাংবাদিকদের ওপর কেন একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে- কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে অব্যাহত সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। প্রকাশ্যেই সিরাজগঞ্জে মেয়রের গুলিতে সাংবাদিক হাকিম খুন হন। যশোরে দ্বায়িত্ব পালনকালে নিজ অফিসে সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল হত্যাসহ বেশ কজন সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন মামলার ক'টির বিচার হয়েছে এ পর্যন্ত?

দেশে সাংবাদিক হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। বিশ্বের যেসব দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়না, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

সাংবাদিক খুন হয় আর তার বিচার হবে না তা কী করে হয়? রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারকে এসব হত্যাকান্ডের বিচারে অবশ্যই আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমহীন কাজ করতে হয় অনেক সংবাদকর্মীর। অনেকটা নিশাচরের ভূমিকা তাদের। সাংবাদিকদের পারিবারিক জীবন বলতে কিছু নেই বললেই চলে। কিন্তু সাংবাদিকদের মূল্যায়ন সমাজে নেই। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকি তো রয়েছেই। সমাজের অনেক সাংবাদিক ত্যাগী, নির্লোভী ও সৎ। তারা মানব কল্যাণে, সমাজ কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন। এই দিকটিও সরকারকে আমলে নিতে হবে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যা বন্ধ করা না গেলে সৎ, মেধাবী, যোগ্য, তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এখন যে সংবাদপত্রে ঢুকছেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এমনিতেই সাংবাদিকদের পেশাগত নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা নেই, তার ওপর যদি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায় কিংবা তারা হামলা এবং হত্যার শিকার হন তাহলে কীভাবে সাংবাদিকতা পেশা বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে?

আমরা মনে করি, সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বাংলাদেশে আজও পর্যন্ত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, কোনো সাংবাদিক হত্যাকান্ডেরই বিচার হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। পথে ঘাটে যদি পুলিশ সাংবাদিকদের পেটায়, সাংবাদিক যদি জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসীর রোষানলে পড়ে, আর বিজিবি যদি একটি ফেনসিডিলসহ খ্যাতিমান কোনো সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করে জেলে পাঠায় তাহলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকেনা। সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। আমলে নিতে হবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।