বিশেষ প্রতিনিধি : সম্মেলনের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও ঘোষণা করতে পারেনি ঝিনাইদহের  শৈলকূপা উপজেলা ও পৌর আওয়ামীলীগের কমিটি। বর্তমান পদ- পদবী দখল করতে একাধিক দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিতরা জেলা  ও  কেন্দ্রে দৌড়ঝাপ করছেন বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই-বাচাই পূর্বক পারিবারিক ভাবে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের পদ-পদবী দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তৃণমুল নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে তারা দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, সাধারন সম্পাদকের পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে উমেদপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাব্দার মোল্লার ছেলে শামীম হোসেন মোল্লা। ২০১৬ সালে টেন্ডারবাজি করতে না পেরে প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন মৃধা ও তার ছেলে নেওয়াজ মৃধাকে শৈলকূপা হাসপাতাল গেটের সামনে থেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারাত্বক জখম করে। বাবা ও ছেলে দুইজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকে। ওই সময় নির্যাতনের ভিডিও পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নজরে আসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি নিজে সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় শামীম মোল্লাকে আসামী করে শৈলকূপা থানায় মামলা দায়ের করা হয় (যার মামলা নং-১০/২০১৬)। এ কারণে শামীম হোসেন মোল্লাকে শৈলকূপা যুবলীগের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে টেন্ডারবাজি করে উপজেলার প্রায় সব ঠিকাদারী কাজগুলো একায় বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার কাজের মান একাবারেই নিম্মমানের। কেউ প্রতিবাদ করলেই শিকার হতে হয় ভয়াবহ নির্যাতনের।
তার হাত থেকে রেহাই পায়নি বর্তমান উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নিলুফা ইয়াসমিনসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ একাধিক ঠিকাদার।

এ বিষয়ে অনেকবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোন সুরহা পাননি ভুক্তভোগীরা। এই পরিবারও উমেদপুর ইউনিয়নের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ দখল করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকার ফান্ডের টাকা জোর পূর্বক তুলে নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। ২০১৬ সালের পৌর নির্বাচনে,২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে ফের ২০২১ সালের পৌর নির্বাচনে ও ২০২২সালের উপজেলা উপ-নির্বাচনে নৌকা প্রতিকের বিরুদ্ধে জোরেসরে ভোট করেন। ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে তার নিজ ইউনিয়নের অধিকাংশ কেন্দ্রেই নৌকা প্রতিকের পক্ষে পোলিং এজেন্ট দিতে দেওয়া হয়নি। বরং স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট কেটে দিয়েছে তার প্রমাণ ভোটের ফলাফল দেখলেই বুঝা যাবে। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি সংখ্যালঘু পরিবাররাও। কবীরপুর মোড়ে অনেক পুরাতন মন্দির ভেঙ্গে জোরপূর্বক রাতারাতি মার্কেট করেছেন। সে কারনে আদালতে একটি মামলাও চলমান রয়েছে।

সম্পূর্ণ জমির বৈধতা না থাকার কারনে বিদ্যুৎ বিভাগ এই মার্কেটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়নি। অভিযোগ রয়েছে উমেদপুর ইউনিয়নের অনেক হিন্দু গ্রামের বাসিন্দাদের জোরপুর্বক জমি দখল করে ভারতে দেওয়ার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে
সামাজিক কোন্দলের কারণে মারামারি সৃষ্টি হলেই নিজেদের লোক নিজেরাই খুন করে প্রতিপক্ষকে দমাতে মামলা করে বাড়ি ছাড়া করা হয় তাদের। প্রতিপক্ষের জমাজমি দখলপূর্বকসহ গাছপালা কেটে নেওয়া হয়। সেই সাথে লুটপাটসহ
বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই আদায় করে মোটা অংকের টাকা। শামীম হোসেন মোল্লার পিতা সাব্দার হোসেন মোল্লা তৎকালিন মুসলীমলীগ তথা রাজাকার পরিবারের সদস্য ছিলেন বলে এলাকায় চাওর রয়েছে। তিনি যখন যে দল ক্ষমতায় আসেন তখন সেই দল করেন। ১৯৭৯ সালে জাসদ গণ বাহিনীর সদস্য ছিলেন সাব্দার হোসেন মোল্লা।

১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির শৈলকূপা থানা কমিটির নেতা ছিলেন। ১৯৯১সালে বিএনপিতে যোগদান করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়ে কোটিপতি বনে যান। ক্ষমতার প্রভাবের কারণে তিনি শৈলকূপার সাবেক ইউএনও আজমল হক, ঝিনাইদহ চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তার ও ঝিনাইদহ মৎস্য কর্মকর্তাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে মারধোর করেন। লেখাপড়া না জানলেও ২০১৩সালে ডিগ্রী পাস দেখিয়ে মিয়া জিন্নাহ আলম ডিগ্রী কলেজের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন তিনি। এরপর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে ব্যাকডেটে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ আদালতে দুইটি মামলা চলমান রয়েছে।

এছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে নেয়। সেই সাথে কলেজের দামি বনজ গাছপালা কেটে বিক্রি করে নিয়েছেন। এ সব ঘটনা পুনরায় নিয়ন্ত্রনে রাখতে নিজ কন্যা ও সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধী ডাক্তার জাকির হোসেনের স্ত্রী মেরিনাকে সভাপতি করে রেখেছেন কাগজে কলমে। শামীম হোসেন মোল্লা ১৩ নং অমেদপুর ইউনিয়নের গ্রাম্য চৌকিদার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নিমাইচন্দ্রকে দলীয় ক্যাডার দিয়ে নির্যাতন করে গ্রাম ছাড়া করে দিয়েছেন। তিনি নদীর জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ইটভাটা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই ইউনিয়নে বীরমুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম মৃধা ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তার এক ছেলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। অপর আরেক ছেলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এই পরিবারকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা যাওয়ার পরে বাড়ি-ঘর ভাংচুর করে এলাকা ছাড়া করে দিয়েছেন। জহুরুল ইসলাম মৃধার ভাই লতা মৃধাকে মারপিট করে পঙ্গু করে রেখেছে।

এই শামীম হোসেন মোল্লার পরিবার ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে ১৯৮৬-১৯৮৮ সালে সংসদ নির্বাচনে ফিড্রম পার্টির কুড়াল মার্কায় প্রতীকের নির্বাচন করেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মারপিট করে আহত করে। ওই সময় নির্বাচনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা নায়েব আলী জোয়ার্দ্দারকে মেরে ফেলার জন্য ফিড্রম পার্টির নেতারা অনেক বার চেষ্টা চালিয়েছেন। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী মোমবাতি মার্কায় ভোট করেছিলেন। ২০২০ সালে আব্দুল হাই এমপি হত্যার চেষ্টা ষড়যন্ত্র মামলা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে ছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেছে শামীম হোসেন মোল্লা মোটা অংকের টাকা খরচ করে নিজের দলীয় লোককে দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

২০১৬ সালে রড়েয়া বাজারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি তার দলীয় নেতা জামায়াত শিবির পরিবারের সদস্যদের দিয়ে ভাংচুর ও আগুন লাগিয়ে দিয়ে তার প্রতিপক্ষ বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়েছিলেন। এই মামলায় আসামী করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ার্দ্দারকে ২০১১ সালে আড়ুয়াকান্দি গ্রামে টুলু নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বাড়ি ছাড়া করা হয়েছে। এবং বাড়িঘর ভাংচুর সহ লুটপাট করা হয়েছে। এই মামলায় আসামী করা হয়েছে শৈলকূপা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আশরাফুল আলমের ছেলে কাজী রাজীব হাসানকে।

শামীম হোসেন মোল্লার বাসা থেকে তামিনগর গ্রামের হত্যা মামলার ৪ আসামীকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা ছিলেন সবাই বিএনপি নেতাকর্মী। শামীম হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে ২০১৬ সালে গাড়াগঞ্জ সোনালী ব্যাংক ভাংচুর করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল করে ইউনিয়ন বোর্ড বিল্ডিং নিমার্ণ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছিল। ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার প্রধান আসামী বুলবুল হুজুরের বাড়ি শামীম হোসেন মোল্লার বাড়ির পাশে এবং একই সামাজিক দলভুক্ত তাকে জামিন করার জন্য বুলবুল হুজুরের নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিএনপি নেতাদের ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বীতায় ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেছেন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করায়েছেন। তার দলবল দিয়ে সুদে ও মাদক ব্যবসা চরম আকারে চালাচ্ছেন। সুদে ব্যবসার কাররে গাড়াগঞ্জ এলাকার দুজন
প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলন বলে কথিত রয়েছে। তার ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাদের নিয়োগ দিয়েছেন তার অধিকাংশ জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী। যশোর আকিজ গ্রুপের ট্রাকসহ পাট ডাকাতি মামলার আসামী হয়েছেন শামীম হোসেন মোল্লার আপন চাচাতো ভাই হাসেম মোল্লা।

এ সকল বিষয় অস্বীকার করে সাব্দার হোসেন মোল্লা ও শামীম হোসেন মোল্লা জানান, আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটা করে প্রতিপক্ষদের বেশি লাভ হবে না।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু জানান, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হলেন আব্দুল হাই। তিনি আবার শৈলকূপা আসনের এমপি। তার মনে যা চাই তিনি তাই করেন। নিজের বলয় ঠিক রাখতে তার পছন্দের ব্যক্তিকে পদ-পদবি দিয়ে থাকেন। তারা বিএনপি করুক বা বাড়ির চাকর হোক সেটা তিনি বিবেচনা করেন না। যার ফলে শৈলকূপায় প্রকৃত আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

(একে/এসপি/এপ্রিল ১১, ২০২৩)