আরিফুন নেছা সুখী

এই সিন্ধু সিন্ধু...
চমকে উঠে পেছন ফিরে সিন্ধু। তাকিয়ে দেখে জানালা দিয়ে বুশরা ডাকছে। চেয়ার ছেড়ে খাটের ওপর শুয়ে মুখ বাড়িয়ে সিন্ধু বলল, এই দুপুরে ডাকছিস কেন? মা বকা দেবেন তো।
—বাইরে আয়, কথা আছে।
—তুই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়া, আমি আসছি।
সিন্ধু খাট থেকে নিচে নামল। বাইরে ভালো করে দেখল মা আশপাশে নেই। নিশ্চয় খেয়ে-দেয়ে শুয়েছেন। বাইরে পা রাখতেই মা ডাকলেন— সিন্ধু কোথায় যাচ্ছো?
—একটু আসছি মা, বলেই সদর দরজা পার হলো সিন্ধু। সিন্ধুকে আসতে দেখে বুশরা বললো, তাড়াতাড়ি আয়। সিন্ধু কাছে আসতেই বললো দু’দিন পরে তো বৈশাখী মেলা, যাবি তো। অনেক কিছু আসবে শুনলাম, নাগরদোলাও আসবে। আর এবার কিন্তু ঘুড়ি আর নাটাই কিনব। সিন্ধু বললো, তা মেলা কোথায় হবে?
বুশরা বললো, পাশের গ্রামে।
পাশের গ্রামে হলে তো মা যেতে দেবেন না।
সিন্ধুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুশরার খুব রাগ হলো, তুই কি ছোট নাকি যে তোকে যেতে দেবেন না। ঠিকই যেতে দেবেন। একটু ভালো করে বোঝাবি। আর এই দু’দিন বেশ ভালো হয়ে থাকবি। ঠিকমতো পড়াশোনা করবি। যা হুকুম করে শুনবি। দেখবি সব সমস্যা মিটে যাবে। আমি তো এখনই গিয়ে পড়তে বসবো। যা গিয়ে যা বললাম তাই কর। বলেই বুশরা বাড়ির পথে পা বাড়ালো। সিন্ধুও বাড়িতে ঢুকলো। মা ঘুমাচ্ছেন। সে পড়তে বসলো। পড়তে বসলেও মাথায় তার মেলা আর নাটাই-ঘুড়ি খেলা করছে। ইস এই দু’দিন যে কবে যাবে!
মাকে যেভাবেই হোক রাজি করাতেই হবে। পড়তে পড়তে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সিন্ধু। আর স্বপ্নে দেখল সে মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত কী যে মেলায় এসেছে। খুব মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সিন্ধু। এমন সময় মায়ের ডাকে ওর ঘুম ভেঙে গেল। মা এসে খাটে বসে ওর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন, সিন্ধু মার কোলে মাথা রাখল। মা বললেন, দেখ এতবড় মেয়ে মায়ের কোলে উঠেছে। তুমি বলছো আমি বড় হয়ে গেছি। তাহলে আমাকে একা কোথাও যেতে দাও না কেন?
—কেন, যেতে দিই না। স্কুলে, কোচিংয়ে তো একাই যাও। মোড়ের দোকানেও একা যাও। বলেই মা উঠে গেলেন।
—ঠিক আছে, মনে রেখো।
মা তাকিয়ে হাসলেন, সিন্ধুও বিছানা ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলো। বিকাল বেলা খেলতে না গিয়ে সে মুরগিগুলো ঘরে তুললো। গাছগুলোতে পানি দিল, বিকালের নাস্তা করে আবার পড়তে বসলো, মা তো অবাক! তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। মেয়ে এত লক্ষ্মী হয়ে গেল কেন?
পরদিনও সিন্ধু মায়ের সব কথা শুনলো, মুরগি তুললো, গাছে পানি দিল। কিন্তু কালকেই তো বৈশাখী মেলা। এখন পর্যন্ত মাকে বলা হয়নি, আজ রাতে যেভাবেই হোক মাকে কথাটা বলতেই হবে। মা খেতে ডাকলেন।
সিন্ধু খেতে খেতে মাকে বলেই ফেলল—মা তো রেগে আগুন। হ্যাঁ, এই রোদের মধ্যে টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়ালে জ্বর আসবে আর মেলায় গিয়ে কি দেখবে? বাড়িতে ইলিশ পান্তা খেও।
সিন্ধু বিড়বিড় করে বলল—নাগরদোলা আসছে।
—কেন তুমি এর আগে ঢাকায় শিশুপার্কে গিয়ে নাগরদোলায় উঠোনি।
—মা আমি যাবো, তাড়াতাড়ি চলে আসবো। আমাদের স্কুলের সবাই তো যাবে।
—হ্যাঁ স্কুলের ওই এক গাদা ছেলের সঙ্গে যাবে।
—না সবাই নাতো, আমি আর বুশরা যাবো।
শেষমেশ মার পরিচিত সেই কথা আমি কিছু জানি না। তোমার বাবা এলে বলো।
পহেলা বৈশাখের ছুটিতে বাবা শহর থেকে বাড়িতে এসেছেন। রাতে বাড়ি ফিরলে সিন্ধু বাবার কাছে বাবার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাইলো। বৈশাখে কি কি করতন তাও জানতে চাইলো। বাবা তো ছোট বেলার কথা মনে করতেই ফিরে গেলেন তার শৈশবে।
তিনি বললেন, বন্ধুরা সবাই মিলে মেলা দেখতে যেতাম। ঘুড়ি কিনতাম, কত যে মজা করতাম। বাবার কথা শুনে সিন্ধু বললো, তাহলে আমাকে মেলায় যেতে দাওনা কেন।
বাবা বললেন কেন যেতে দিব না। অবশ্যই যেতে দিব।
—কিন্তু মা তো যেতে দিতে চাইছে না।
—ও এই কথা, তাইতো বলি হঠাৎ ছেলেবেলার কথা কেন। ওরে দুষ্ট। আমার সঙ্গে চালাকি। ঠিক আছে আমি তোর মাকে বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু সাবধান কোন দুষ্টুমি করবে না। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। সিন্ধু বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
—হইছে হইছে ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।
ঘুম কী আর হয়! সারা রাত স্বপ্ন দেখে কাটালো। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাবার কিনে দেয়া লাল-সাদা জামা পরে সিন্ধু মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কোনোরকম একটু খেয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেলা দেখতে বের হলো। রাস্তায় বুশরার সঙ্গে দেখা হলো। তারপর দুই বন্ধু মেলা দেখতে গেল। মেলা দেখছে, মিষ্টি কিনছে, নাগরদোলায় চড়ছে, আর ও হ্যাঁ দুই বন্ধু নাটাই-ঘুড়িও কিনেছে। কিনে বাড়ি ফিরতেই ওরা একটি বটগাছের নিচে একটা বয়স্ক লোককে বসে কাঁদতে দেখলো। সিন্ধু এগিয়ে এসে বললো—ও দাদু তুমি তো বড় মানুষ তুমি কাঁদছো কেন।
লোকটা বললো এই দেখ আমার খেলনাগুলো সব ভেঙে গেছে। এগুলো এখন আর কেউ কিনবে না। মেলাও শেষ পর্যায়ে। এখন বাড়ি থেকে খেলনা আনতেও পারবো না। আমার নাতনীটার পরীক্ষার ফিসও দিতে পারবো না। ওর পরীক্ষা দেয়া হবে না। এ কথা শুনে ‍ওদের খুব মন খারাপ হলো।
সিন্ধু বললো, আমার তো মাত্র দশ টাকা আছে। বুশরা তোর কত টাকা। বুশরা বললো, সাত টাকা। এই সতের টাকা দিয়ে তো কিছু হবে না। চলো দাদু আমাদের বাড়ি চলো, আমার একটা মাটির ব্যাংক আছে। সেখানে নিশ্চয় কিছু টাকা জমা হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে তোমার নাতনীর পরীক্ষার ফিস দিও। কিন্তু সে ওদের সাথে যেতে সংকোচ করছিলেন। অনেক বোঝানোর পর উনি সিন্ধুর সঙ্গে ওদের বাড়ি যেতে রাজি হলো।
বাড়ি গিয়ে সিন্ধু বাবা-মাকে সব খুলে বললো। বাবা বললেন, থাক তোমার ব্যাংক ভাংতে হবে না। আমি উনাকে টাকা দিচ্ছি। সিন্ধুর মা উনাকে খেতে দিলেন। উনি খুব খুশি হলেন। সিন্ধুও খুব খুশি হলো।