মোহাম্মদ ইলিয়াছ


দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাছে ভাতে বাঙালি। কাজেই এই মাছ আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যে সম্পদ আমাদের শুধু পুষ্টি জোগায় না, এ সম্পদ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করেও আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। সে জন্য মৎস্য উৎপাদনে আমরা গবেষণা করে যাচ্ছি এবং অনেক সাফল্যও পেয়েছি। কিন্তু সমুদ্র সম্পদ আহরণে আমাদের এখনো অনেক কাজ করতে হবে এবং আমরা সেটা করব বলেই বিশ্বাস করি।’

বঙ্গোপসাগরে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে।২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে এ রায় হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৯৪% পণ্য বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে পরিবহণ হচ্ছে।এছাড়া, সমুদ্র থেকে কিছু সম্পদ আহরিত হচ্ছে, যার পরিমাণ বার্ষিক ৯৬০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৫ শতাংশের মতো। অবশ্য, দেশের সমুদ্র এলাকা মৎস্য, গ্যাস, তেল, সি-উইড ইত্যাদিতে ভরপুর। দেশের সমুদ্র সৈকতও বিশ্বের মধ্যে দীর্ঘতম, যা পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র। এছাড়া, দেশের সমুদ্র এলাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর, নৌ যোগাযোগ, উপকূলে বায়ু, সৌর ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও ভাসমান পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শহর-মার্কেট করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ দেশের সমুদ্রকেন্দ্রিক ব্যাপক উন্নতি ও কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৫ জানুয়ারি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ তথা ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া গেছে, যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান। এছাড়া, ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের সমুদ্র সীমায়

ব্লু ইকোনমি—সময়ের অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। সমুদ্র-সম্পদনির্ভর অর্থনীতিই ব্লু ইকোনমি নামে পরিচিত। অন্যভাবে বললে, নীল (ব্লু) সমুদ্রকেন্দ্রিক যে অর্থনীতি, তাই সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি। বিশ্বব্যাংকের মতে, সুনীল অর্থনীতি বলতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর জীবিকার সংস্থান ও সামুদ্রিক প্রতিবেশের উন্নয়নকে বুঝায়। ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন।

উল্লেখ করার বিষয়, বিগত বছরগুলোতে পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে যতগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় সবগুলোতেই ব্লু ইকোনমি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। সংশ্লিষ্ট অন্য আলোচনা-সভাগুলোতেও ঘুরেফিরে আসে সুনীল অর্থনীতি। এর কারণও স্পষ্ট। ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা মিটাতে পৃথিবীর দেশগুলো চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে ব্লু ইকোনমির ধারণা বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে।

এখন সবারই জানা, ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটা দেশ। দেশের বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে ব্যাপক পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে দেশের অর্থনীতিকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করতে পারি আমরা। ২০১৪ সালে আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্র জয় করেছি। এতে করে বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রে অফুরন্ত সম্ভাবনার মধ্যে প্রধান উৎস মাছের বাইরেও রয়েছে জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্প, সামুদ্রিক জলজ প্রাণীর চাষাবাদ, লবণ উৎপাদন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সামুদ্রিক খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, সমুদ্রবন্দর ও সমুদ্র পর্যটন।

মনে রাখা দরকার, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে ১৪ নম্বর লক্ষ্যটি সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে গোটা সমুদ্রসীমা তথা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের যথাযথ ব্যবহার করা গেলে ব্লু ইকোনমি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে—এই কথা বলাই বাহুল্য। তেল-গ্যাস উত্তোলন, মত্সসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন ক্ষেত্রগুলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জিডিপি অর্জন সম্ভব। তাছাড়া আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইলের সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে আরো সুদৃঢ় করা সম্ভব। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ‘কু্ল’ পাওয়া গেছে সমুদ্রের ৩০-৮০ মিটার গভীরে, যা উত্তোলন নিশ্চিত করতে পারলে দেশে সিমেন্ট শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞমহল। ব্লু ইকোনমির মূল উদ্দেশ্যই হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, সামাজিক পুঁজির সৃষ্টি করে আয় বাড়ানো ও পরিবেশ, সঞ্চয়-বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই সুযোগটি লুফে নিতে পারে।

তবে এ কথাও সত্য, বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। দক্ষ জনবলের অভাব, সমুদ্র সম্পদের সঠিক তথ্যের অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবের মতো সমস্যা নিয়ে কাজ করা না হলে ব্লু ইকোনমির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব আমরা। এসব বিষয় মাথায় রেখে সঠিক ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। আশার কথা হলো, সরকার ব্লু ইকোনমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা বিকাশের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ চালু করা হয়েছে। মহেশখালীতে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা ও ঢেউকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদনের জন্য চালু আছে বিশেষ প্রকল্প। শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পতেঙ্গা ও সেন্টমার্টিনসহ কয়েকটি জায়গায় এমন সব প্রকল্প রয়েছে, যা আমাদের আশান্বিত করে। যদিও এ ধরনের প্রকল্প ও উদ্যোগ আরো প্রসারিত করা সময়ের দাবি। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মাথায় রাখতে হবে, সমুদ্রসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নানাবিধ সংকটের মোকাবিলা করা সহজতর হবে। অন্যান্য খাতের জন্যও ব্লু ইকোনমি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা ব্যাপক। অবিলম্বে একে কাজে লাগাতে হবে। সে জন্য এর বাধাগুলো দূর ও সম্ভাবনাগুলো সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। সম্ভাবনার অন্যতম হচ্ছে, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান। কারণ, বর্তমানে তেল-গ্যাসের মূল্য আকাশচুম্বী হয়েছে, যা সহসাই হ্রাস পাবে না। দেশে গ্যাসের মজুদও শেষ হয়ে আসছে। তাই চাহিদা মাফিক গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এলএনজিনির্ভর হচ্ছে দেশ। অবিলম্বে নতুন গ্যাসকুপ সন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে সমুদ্র ও মূল ভূখন্ডে। আর সেটা করতে হবে প্রধানত বাপেক্সের মাধ্যমে। সে জন্য সংস্থাটির সক্ষমতা, জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়িয়ে প্রয়োজন মোতাবেক করতে হবে। এই সঙ্গে মৎস্য আহরণ ও পর্যটনের উন্নতির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে সমুদ্র বিষয়ক প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করে কাজে লাগাতে হবে। তবেই ব্লু-ইকোনমির যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তা বাস্তবে রূপ পাবে। সমুদ্র বিজয় সার্থক হবে। দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষামন্ত্রণালয়, ঢাকা।