আবীর আহাদ


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একটি নির্বাচিত পরিষদ দেখতে চান। সেজন্য তিনি সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানসহ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ। তারা দেদারসে যাকেতাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর একটা লাভজনক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চাইতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন দেশবাসী প্রতিবাদমুখর হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে প্রতিবাদের কথা পৌঁছয় কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে! অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচিত কমান্ড কাউন্সিলের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর এ লাভজনক প্রকল্পটি ছেড়ে দিতে  চান না বলেই জামুকা নানান চক্রান্ত করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে অকেজো করে রাখতে চাইছে!

প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন চান বলেই একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছেন যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত পেয়ে আগামী ২০ মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে গত ৯ এপ্রিলের মধ্যে মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও ১০ এপ্রিল মনোনয়ন ফরম দাখিলের নির্দেশনা দেন। সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা সুদীর্ঘকাল পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের খবরে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার নিয়ে নির্বাচন কার্যক্রমে লিপ্ত থাকেন।

ইতোমধ্যে আমাদের কাছে খবর আসে যে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল নির্বাচনে একটা নপুংসক পরিষদের হাতে কমান্ড কাউন্সিলের ক্ষমতা অর্পণ করার লক্ষ্যে সরকারের নাম ভাঙিয়ে স্বয়ং মুক্তিযুবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ও শাজাহান খান নিজেদের মতো করে একটা প্যানেল দাঁড় করাচ্ছেন। তারা মূলত একটা পাপেট পরিষদ করে জামুকার মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রকল্পটি চালু রাখার লক্ষ্যে চেয়ারম্যান হিসেবে তেমন একজন নপুংসককে খুঁজছিলেন। সেই নপুংসক চেয়ারম্যানসহ পারিষদবর্গ খুঁজতে খুঁজতে সময় গড়িয়ে যায়। তারা প্যানেল দিতে বার হন। এমনি অবস্থায় ৯ এপ্রিল পার হয়ে গেলে মন্ত্রী মোজাম্মেল ও শাজাহান খানসহ আরো কিছু কুচক্রী মিলে তথাকথিত অনিবার্য কারণ দেখিয়ে নির্বাচন স্থগিত করে দেন! এ প্রক্রিয়ায় গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজে চরম হতাশা ক্ষোভ ও অপমানের বিষক্রিয়া দেগা দেয়। বয়সের কারণে হয়তো এটাই ছিলো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ নির্যাতন। সারা দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বুক থেকে বেদনার দীর্ঘশ্বাস নির্গত হচ্ছে। কেউ কেউ যারা নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার সমস্ত যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভুয়া তাড়ানোর প্রসঙ্গটি সামনে এনে নির্বাচন বয়কটের কথা বলছেন।

বাংলাদেশে এটি তো সত্য যে, আমিই সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা বলেছি। আমিই প্রথম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অপসারণের কথা বলেছি। এ দুটো দাবি নিয়ে দীর্ঘ ৬/৭ বছর যাবত প্রবলভাবে লেখালেখিসহ একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে হেন কোনো পন্থা নেই যা আমরা গ্রহণ করিনি। পরে বুঝতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়েই ফাইটটা দিলে সব মুক্তিযোদ্ধার সমর্থন পাওয়া যাবে। এবং তখন আমরা প্রবল চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে আমরা বুঝাতে সক্ষম হবো। ঠিক এ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে গিয়েছিলাম।

সেই নির্বাচনে আমাদের প্যানেলের পক্ষে দেশের বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা স্বত:স্ফূর্ত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। দিন দিন যেভাবে আমাদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো, তাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমাদের পক্ষে নীরব ভোটবিপ্লব সংঘটিত হতো। নির্বাচন স্থগিতকরণের পশ্চাতে এটাও একটা অন্যতম কারণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি তাদের কায়েমি স্বার্থের কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাজের দু:খ ব্যথা হতাশা ও কান্নার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন না বলা চলে। এজন্য আমরা বহুদিন থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তাঁর একজন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা রাখার দাবি জানিয়ে আসছি যাতে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক পরিস্থিতি দ্রুতগতিতে তাঁর জ্ঞাতার্থে এসে যায়। আজ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল হলো, এর পশ্চাতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানের কালো হাতের কারসাজি, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এবং তারা তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার লক্ষ্যে কখনোই মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে শক্তিশালী বা নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো শক্তিশালী পরিষদ সেখানে আসতে দেবে না!

অতএব, মুক্তিযুদ্ধের পবিত্রতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বিলুপ্ত, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচার করা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্যে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।