গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, বিশেষ প্রতিনিধি : জয়া আচার্য (২৭) নামের এক স্কুল শিক্ষিকা (বিধবা) বখাটেদের বিরুদ্ধে থানায় 'ধর্ষণ চেষ্টা'র মামলা করে এখন সন্ত্রাসীদের হুমকীতে ঘরেই অনেকটা 'গৃহবন্দী' হিসেবে প্রচন্ড আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে গত এক সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে ওই স্কুল শিক্ষিকা বাইরে বের হতে পারছেন না। তবে থানায় মামলা হওয়ার পর 'মূল আসামী' গ্রেপ্তার হলেও, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সহযোগি বখাটেদের নানা হুমকীতে গোটা হিন্দু পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন। ঘটনাটি ঘটেছে নাটোর জেলা সদরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটোর সদর উপজেলার দক্ষিণ আলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা, উপজেলা সদরের কান্দিভিটা স্টুডেন্ট কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ওই শিক্ষিকার নাম জয়া আচার্যের (২৭)। তার স্বামী দুই বছর আগে মারা যান। এ দম্পতির অনিন্দিতা নামে ৪ বছর বয়সি একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই সুশ্রী ওই জয়া আচার্যের ওপর কুনজর পড়ে স্থানীয় আনোয়ার হোসেন নামে এক বখাটের।

স্কুল শিক্ষিকা জয় আচার্য এ প্রতিবেদককে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, 'আমার স্বামীর মৃত্যুর পরই বখাটে আনোয়ার হোসেন আমাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। স্কুলে যাওয়া আসার সময় আনোয়ার প্রায়ই আমাকে উত্যক্ত করার পাশাপাশি অনৈতিক কুপ্রস্তাবও দিত। এমনকি প্রায়ই বাসায় আসার চেষ্টা করতো। ফলে তার নানা কুপ্রস্তাব থেকে বাঁচার জন্য আমরা একাধিকবার বাসাও বদল করেছি। এরপরও আনোয়ারের কাছ থেকে কোনভাবেই রেহাই পাচ্ছিলাম না। '

জয়া আচার্য আরও জানান, ঘটনার দিন গত ৯ এপ্রিল দুপুরে সে আমাদের বাসায় আচমকা এসে জোরপূর্বকভাবে আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ সময় আমার আর্তচিৎকারে লোকজন এগিয়ে এলে সে পালিয়ে যায়। পরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় সে তার দলবল নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হামলা করে। এসময় আমার বাবা ও ভাইয়ের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাদেরকে মারধর করে। পরে বাসার যাবতীয় মালামাল তছনছ করে বের হয়ে যায়।

এ ঘটনার পর আমি থানায় গিয়ে বাদী হয়ে আনোয়ারকে 'প্রধান আসামি' করে ৫ জনের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করি। এরপরই পুলিশ আনোয়ার ও তার সহযোগি রানা কে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়।

জয়া আচার্যের বাবা তপন আচার্য জানান, 'মামলা করার পর আনোয়ার সহ দুজন গ্রেপ্তার হলে, বখাটে আনোয়ারের সহযোগি গুন্ডা পান্ডারা প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে নানাভাবে আমাকে, আমার ছেলেকে ও মেয়ে জয়াকে হত্যার হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের হুমকীতে আমার মেয়ে এখন ঘরে অনেকটা 'গৃহবন্দী' অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে মেয়েটি আর স্কুলে যেতে পারছেনা। এমনকি ঘর থেকে কোথাও বের হতে সাহস পাচ্ছেনা। আমরাও সর্বক্ষণ থাকি আতংকে। মোটকথা সন্ত্রাসীদের ভয়ে আমার গোটা পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।'

জয়া আচার্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'শুনতেছি, ঈদের পর আনোয়ার নাকি জামিনে মুক্ত হয়ে এসে আমাদের সকলককে জলন্ত পুড়িয়ে মারবে। এ অবস্থায় আমরা এখন কোথায় যাবো, কিভাবে এখানে থাকবো, সেটি নিয়েই চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছি।'

জয়া বলেন, 'আমরা তাই এ অবস্থায় মমতাময়ী মা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার এবং আমাদের গোটা পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য কড়জোরে আবেদন করছি।'

এদিকে গত ১৯ এপ্রিল এ ঘটনায় করণীয় কি? শীর্ষক নিউজ ২৪ আয়োজিত একটি লাইভ টকশোতে দেশের হিন্দু নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করে অবিলম্বে স্কুল শিক্ষিকা জয়া আচার্য ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নাটোরের স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন। সিনিয়র সাংবাদিক সুভাষ সাহার পরিচালনায় ওই টকশোতে অংশ নেন বিশ্ব হিন্দু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কান্তি নাগ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহোজোটের মহাসচিব এডভোকেট শ্যামল কান্তি দে, কানাডা থেকে দাস মিডিয়ার কর্ণধার সিনিয়র সাংবাদিক প্রদীপ কুমার দাস, দৈনিক বাংলা ৭১ এর বিশেষ প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, বগুড়া থেকে মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক বিকাশ স্বর্ণকার ও জাতীয় হিন্দু মহোজোটের বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলীয় সমন্বয়ক সাংবাদিক সন্তোষ কুমার মাহাতো।

বক্তারা অবিলম্বে নিগৃহীত স্কুল শিক্ষিকা জয়া আচার্যের জীবনের নিরাপত্তা ও তার গোটা পরিবারটিকে সন্ত্রাসীদের হুমকীর কবল থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক সুভাষ সাহা বলেন, 'ঘটনাটির প্রতিকার ও হিন্দু পরিবারটির বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ খবর নিতে আমাদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা থেকে আগামি ২৬ এপ্রিল নাটোরে রওয়ানা হবো। সেখানে আমরা এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সাংসদের সহযোগিতা চাইবো। এরপর ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে পুরো ঘটনা জাতির সামনে তুলে ধরবো।’

এ বিষয়ে আজ দুপুরে কথা বলতে দৈনিক বাংলা ৭১ এর পক্ষ থেকে নাটোরের পুলিশ সুপার সাইদুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিযেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এটিএম মাইনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে, তিনি দৈনিক বাংলা ৭১ ও উত্তরাধিকার নিউজ ৭১ কে বলেন,'এরকম ঘটনা আমার জানা নেই। তবে আপনার (সাংবাদিক) মাধ্যমে যখন জানতে পেরেছি, তখন এ বিষয়ে এখনই পুলিশের সংশ্লিষ্টদেরকে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলে দিচ্ছি। মেয়েটি ও তার পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে পুলিশ।'

(জিডি/এসপি/এপ্রিল ২১, ২০২৩)