গোপাল নাথ বাবুল


অন্যান্য দিবসগুলোর মতো ঘটা করে পালিত না হলেও প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস পালিত হয়। এ বছর ঈদুল ফিতরের পরেরদিন পড়ায় এক প্রকার নীরবেই চলে গেছে দিবসটি। এ দিবসে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়না বললেই চলে। এমনকি অনেকেই জানেন না, বই দিবস নামে একটি দিবস আছে। অথচ ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল ইউনেস্কো প্রথমবারের মতো বিশ্ব বই দিবস পালন করে। এরপর থেকেই দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। 

বিশ্ব বই দিবস অন্যান্য দিবসের চেয়ে বেশি আবেদন রাখার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো-আমাদের মতো সাধারণদের মনে শুধু নয়, অসাধারণদের মনেও সে দিবসটি তেমন আবেদন সৃষ্টি করে না। অথচ মানব সভ্যতার বিকাশে বইয়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাই জীবনের জন্য, সফল জীবন গঠনের জন্য বইয়ের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, ব্যায়াম যেমন আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে, তেমনই বই পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে সুস্থ ও আনন্দময় রাখতে পারি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বই পড়েন তাদের অধ্যয়ন ডিমেন্সিয়া এবং অ্যালজাইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। একটি ভালো বই মানুষের মনশ্চক্ষু খুলে দেয়ার পাশাপাশি জ্ঞান ও বুদ্ধিকে বিকশিত করে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এর সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হয় না। একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান চিরকালই হৃদয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখে। সুতরাং বই পড়াও একটি ব্যায়াম। তাই মস্কিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশি হিসেবে বিবেচনা করে বই পড়ার মাধ্যমে নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী ও সজীব থাকে। তাইতো জনাথন সুইফট্ বলেছেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান।’

বই পড়লে শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। তাছাড়া, নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই। বই পড়ার মাধ্যমে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি উন্নত হয়, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, আত্মার প্রশান্তি যোগায় এবং সারাদিনের ক্লান্তিকে নিমিষেই দূর করে, প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করে, অনেক অজানা শব্দ আয়ত্ত করা যায়, যা আমাদের প্রাত্যাহিক কথোপকথনে কাজে লাগে। তাই ফ্রাঙ্কস্ কাফকা বলেছেন, ‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাঁধা সমুদ্র, সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙ্গার কুঠার হলো বই।’

বই পড়ার অভ্যাস যতই বাড়বে ততই সমাজের মঙ্গল। বই পড়ার অভ্যাস বাড়া মানেই অন্ধকার এলাকা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা। বই মানুষের যোগাযোগ ক্ষমতাকে উন্নত করে এবং জ্ঞানী মানুষদের সঙ্গে একটি সেতু হিসেবে সংযোগ স্থাপন করে। অনেকে তাদের মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে বইয়ের আশ্রয় নেন। এ বিষয়ে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’

একটা সময় ছিল, এ দেশের প্রতিটা সচল ও সৌখিন পরিবারে একটা পারিবারিক লাইব্রেরী থাকতো এবং ওইসব লাইব্রেরীতে প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ থাকতো। একটা জাতিকে ‘বই পড়া’ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে একটা লাইব্রেরীর গুরুত্ব অনেক। এ ব্যাপারে বিমল মিত্রের একটি গল্পের কথা মনে পড়ে। গল্পটিতে ভাইঝির বিয়ে ঠিক করতে পন্ডিতমশাই জমিদার বাড়িতে যান। সেখানকার সবকিছু পছন্দ হলেও এতো বৈভব ও এতো বড় বাড়িতে একটা লাইব্রেরী না থাকায় তিনি এ বিয়ে দিতে রাজী হননি।
আয়তাকার একটি বই মানব ভাবনা আর তথ্যের সেই আধার, যা অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের চেয়ে আরও গভীরভাবে মানব সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে।

এ বিষয়ে অ্যালবার্তো ম্যানগুয়েল ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘অ্যা হিস্টোরি অফ রিডিং’-এ লিখেছেন, ‘ইচ বুক ওয়াচ অ্যা ওয়ার্ল্ড আনটু ইটসেলফ, অ্যান্ড ইন ইট আই টুক রিফিউজ।’ কিন্তু দুঃখের বিষয়-বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে বইয়ের দূরত্ব ক্রমে বাড়ছে। তারা বইয়ের পাতা আর উল্টাতে চায় না। ৮০/৯০ দশকেও আমরা টিপিন ছুটিতে যেতাম স্কুল/কলেজের লাইব্রেরীতে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরীর পরিবর্তে মোবাইলে মনোনিবেশ করে বিভিন্ন গেইম খেলে সময় নষ্ট করে।

অথচ কীভাবে বই পড়ে নিজের প্রতিভাকে ধনী করা যায় তা দেখিয়ে গেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তো শুধু পাঠকই ছিলেন না, তিনি বইকে সযতেœ বাইন্ডিং করে রাখতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ লিখেছেন, ‘কার্লাইলের ন্যায় আমিও বলিতে পারি, অধ্যয়নই আমার প্রধান বিশ্রাম।’ ১৯৬১ সালের ৭ জুন সৈয়দ মুজতবা আলী অধ্যাপিকা সালমা চৌধুরীকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘বেশিরভাগ সময়ই চলে যায় টুকিটাকি লিখে হাঁড়ির চাল জোগাড় করতে। তদুপরি আমার লেখার শখ নেই, আছে পড়ার শখ। অবকাশ পেলেই মনে হয় আর একটুখানি পড়ে নিই। এ যেন এক মৌতাত। এর থেকে এ জীবনে আর নিষ্কৃতি পাবো না।’ গ্রামবাংলার নিবিড় অভিজ্ঞতা নিয়ে অসাধারণ গল্প ও উপন্যাস লেখা বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় পড়তেন ইংরেজি পত্রিকা ‘ওয়াইড ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন।’ যে পত্রিকায় বহু বিচিত্র জাতি, ক্যানিবালস্ এবং অদ্ভূত ভৌগোলিক ভূমির বিবরণ থাকতো। এজন্যই তিনি আফ্রিকায় না গিয়েও লিখতে পেরেছেন ‘চাঁদের পাহাড়’।

শঙ্করী প্রসাদ বসু, সুরীন্দ্রনাথ দত্ত, শঙ্খ ঘোষ প্রভৃতি বিখ্যাত লেখকবৃন্দ প্রচুর বই পড়তেন। তবে বিশ্বে বৃটেনের ৯১ বছর বয়সী লুইজ ব্রাউন সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন বলে জানা যায়। তিনি ২৫ হাজারের বেশি বই পড়েছেন। কিন্তু একটা বইও তিনি কিনে পড়েননি, সবই পড়েছেন লাইব্রেরীতে থেকে নিয়ে। এর বাইরে কত বই পড়েছেন তার কোনো হিসেবে নেই। তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ডজনখানেক বই পড়ে শেষ করতেন। আটলান্টিক মহাসাগর আর আর্কটিক সাগরের মাঝখানে অবস্থিত নরডিক অঞ্চলের মাত্র ৪০ হাজার বর্গমাইলের একটি ছোট্ট বরফের দেশ আইসল্যান্ড। যার লোকসংখ্যা মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি। অথচ এ ছোট্ট দেশটি বই পড়ার হারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে।

দেশটির মানুষ গড়ে সবচেয়ে বেশি বই পড়েন। আবার অনেকের বই পড়ার পরিবর্তে বই সংগ্রহ করারও নেশা থাকে। তারা বিভিন্ন লাইব্রেরী বা বইমেলায় গিয়ে নানা পছন্দের বই কিনে সংগ্রহ করেন।
সুতরাং খাবার যেমন শারীরিক পুষ্টি যোগায় তেমনি বই মানসিক পুষ্টি যোগায়। বই চিন্তা ও মননকে পরিশীলিত করে এবং দৃষ্টিকে প্রসারিত করে। একটা বই শুধু তথ্য দেয় না, নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। বই যারা পড়েন না, তারা জীবনে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে গেইম অব থ্রনস্ সিরিজের চরিত্র টিরিয়ন ল্যানিস্টারের মুখ নিঃসৃত একটি বাক্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন,“একটি তরবারিকে যেমন ধারালো রাখার জন্য শাণপাথর দিয়ে শাণ দিতে হয় তেমনি মস্তিষ্ককেও শাণ দিতে হয় বই দিয়ে। এজন্যই বই পড়ি।”

কারণ, জ্ঞানার্জনের যত রকম পথ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম পথ হলো বই পড়া। এ ক্ষেত্রে বইয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য অসাধারণ এক উক্তি করেছেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও সাহিত্যিক টলস্টয়। তাঁকে জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সম্পর্কে জিগ্যেস করা হলে তিনি বলেন,“জীবনে তিনটি বস্তু প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই, বই আর বই।”

সুতরাং বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু, বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালী এবং অন্যান্য দিবসের মতো সরকারি-বেসরকারিভাবে ‘বিশ্ব বই দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালিত হোক, যাতে বই এবং বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম বুঝতে ও জানতে শিখে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।