রহিম আব্দুর রহিম


ভারতের বহুল প্রচারিত এবং প্রথম শ্রেণি'র বাংলা দৈনিক 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র ২৭ এপ্রিল প্রথম পাতায়  প্রকাশিত তিনটি সংবাদ শিরোনামের একটি ছিলো, 'মাওবাদী হামলা ১১ জন নিহত ছত্তীসগঢ়ে।' এই শিরোনামের  সংবাদ বডির সারসংক্ষেপ,' মাওবাদী সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত রির্জাভ গার্ডের ১০ সদস্যের একটি দল ২৬ এপ্রিল, ভাড়া করা একটি মিনি ভ্যানে করে  অরনপুরে অভিযানে যায়।দলটি ফেরার পথে  সন্ত্রাসীদের বোমা বিস্ফোরণে  অভিযানে অংশ গ্রহণকারী ১০ জোয়ানসহ মিনি'র ড্রাইভার মারা যান। বোমাটি এতই শক্তিশালী ছিলো যে, বিস্ফোরণে  ভ্যানটি প্রায় ২০ ফুট শুন্যে উঠে দেড়শো ফুট দূরে ছিটকে পরে। এই সংবাদটি চোখে পড়ার পর ভীষণভাবে আতংকিত ছিলাম। পৃথিবীর অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত,যে দেশটি জনবসতির দিক থেকে বর্তমানে চীনকে পেছনে ফেলেছে। রূপ সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ, প্রাকৃতিক লীলাভূমি  ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনা। সেই দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ সদস্যসহ ১১টি তাজা প্রাণ সন্ত্রাসীদের নির্মম আক্রমনে ধ্বংস! ঘটনাটি কোনভাবেই স্বাভাবিক নয়, মেনে নেওয়া যায় না। তবে দায়িত্ব পালনে করতে গিয়ে যে জোয়ানরা প্রাণ দিলো তারা 'শহীদি' মর্যাদা বহণকারী স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব। 

তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।ভারত সরকারের উচিৎ যেকোন মূল্যে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া।মানবসভ্যতা এমনটাই কামনা করে। পত্রিকাটির ডানের শীর্ষে দু'কলামে জোড়ে অন্য শিরোনামটি ছিলো, 'পুলিশকে বেদম মার, প্রাণ ভিক্ষা! এই শিরোনামের সংবাদ বডির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, 'গত ২১ এপ্রিল উত্তর দিনাজপুরের একটি এলাকার বাড়ির পুকুর ধারে পড়েছিল এক নাবালিকার মৃত দেহ। মৃত বালিকার পরিবারের দাবী, মেয়েটিকে গণধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে। ওইদিন রাতেই মামলার মূল অভিযুক্ত ও তাঁর ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এই ঘটনায় এলাকার বিক্ষুব্ধ জনমানুষ কালিয়াগঞ্জ শহরে প্রতিবাদ মিছিল করেন। পরে তারা অভিযুক্ত অন্যান্য আসামীদের দ্রুত গ্রেফতার করে তাদের ফাঁসির দাবীতে স্বারকলিপি দিতে যান থানায়। এই নিয়ে পুলিশ -জনতার সংঘর্ষের সূত্রপাত। থানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ। যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী করতেই পারেন, বিচারের দাবীতে মিছিল স্মারকলিপি দেওয়াটা শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক কায়দায় হলে ওই গোষ্ঠীকে পৃথিবীর সকল মানবিক সমাজ ধন্যবাদ জানাবে।

সংবাদপত্রের ভাষায় তাদের বিক্ষুব্ধ বলে অবহিত করবে। যদি তা উল্টো হয়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মত ঘটনা ঘটায়, তবে বিশ্ব মানবতা তাদের অসভ্য বলে ধিক্কার দেবে। সংবাদপত্রের ভাষায় যাদের উশৃঙ্খল জনতা বিশেষণে বিশেষায়িত করবে। পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার পর দু'জনকে গ্রেফতার করেছেন। এটা স্বাভাবিক বিচার নিশ্চিত হবার প্রাথমিক ধাপ। ঘটনাটি ধর্ষণ এবং খুন, যা স্পর্শকাতর! খুব সাবধানে পুলিশকে এগুতে হবে। এক্ষেত্রে পুলিশকে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে গ্রেফতার অভিযান চালাতে হবে।তদন্তে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সময়ের ব্যাপার থাকে, ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুলিশকে সেই সময় সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব সবার। তবে কেনো এমনটা হচ্ছে!

অপরদিকে পুলিশ মারদাঙ্গার সময় একজন টটোচালকে গ্রেফতার করেছে, এই টটোচালক পরিস্থিতির শিকার কি না,তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পুলিশেরই। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে'পুলিশ সর্বদায় দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে ব্রত।' পুলিশ এই সত্যটি প্রমাণ করার সুযোগ আরও একবার পেয়েছেন। আরও একটি আতংকিত হবার মতো সংবাদ শিরোনাম ছিলো, "অস্ত্র হাতে ক্লাসে, চেষ্টা 'পণবন্দির।" এই সংবাদটির বডিতে যেমন আতংক রয়েছে, তেমনি রয়েছে,অনুপ্রেরণা, প্রশংসা, সাহসিকতা এবং দায়িত্ববোধের অমর স্মারক।'

মালদার মুচিয়া গ্রাম, পঞ্চয়েত নিমুয়া, এই এলাকার দেব বল্লভ (৪২), পিঠে কালো ব্যাগ নিয়ে ফিল্মী কায়দায় প্রবেশ করে পুরাতন মালদহের মুচিয়া চন্দ্রমোহন হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। ক্লাসে ঢুকেই পেট্টোল বোমা সাজিয়ে নেয়, এরপর পিস্তল উঁচিয়ে ক্লাসের শিশু শিক্ষার্থী ও শ্রেণি'র বাংলা শিক্ষককে জিম্মি করে ফেলে। ঘটনাটি ২৬ এপ্রিল বুধবার দুপুর বেলার। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি জানতে পারেন, মালদহের ডিএসপি (আইন শৃঙ্খলা) আজাহার উদ্দীন খান। এই কর্মকর্তার অফিস থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের ঘটনাস্থলে তিনি দ্রুত পৌঁছান। এই কর্মকর্তা পুলিশের উর্দি খুলে ফেলেন, গ্রামের এক ব্যক্তির কাজ থেকে টি-শার্ট নিয়ে তা পরে নেন। পুলিশের বুট খুলে চটি পরেন। তিনি এবার সাংবাদিক সাজান, ফিল্মী কায়দায় প্রবেশ করেন ওই ক্লাসে। এবার তিনি অস্ত্রধারী দেব বল্লভের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেন।

একপর্যায় সুযোগ বুঝে খপাস্ করে ধরে ফেলেন অস্ত্রধারীকে। পরে তাকে নিরস্ত্র করলে জিম্মি দশা থেকে মুক্তিপায় ৭১ জন শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষক। এই ঘটনাটি ভারত ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রশংসায় ভাসছে। কারণ, কোমলমতি শিশুরা জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হবার পুলিশের কৌশলগত কাহিনীটি সবারই মনে থাকার কথা। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হবার ঘটনাটি যদি পড়ুয়া শিশুরা মনে প্রাণে ধারন করে থাকে, তবে মালদহের এই স্কুল থেকে ২৫-৩০ বছর পর একসাথে অর্ধ শতাধিক সাহসী, দক্ষ এবং চৌকস আজাহার উদ্দীন খানের জন্ম হবে। যে আজহাররা জীবনবাজী রেখে দায়িত্বে পালনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

লেখক : শিক্ষক কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।