মো. আতিকুর রহমান : অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তার আদান-প্রদান আধুনিক গণতন্ত্রের মূল শর্ত। যা জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীনতা-উত্তর নব্বইয়ের দশকে সরকারি টিভি চ্যানেল বিটিভির পাশাপাশি বেসরকারি একুশে টিভিকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সুযোগ দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ তৎকালীন সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর জন্য নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু নতুন টিভি চ্যানেল জনগণের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার মতো মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে কার্যক্রম শুরু করে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে এদেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বর্তমান বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ২৬টি। অবাধ তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারে এসব ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এদেশের গুরুত্ব এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এসব টিভি চ্যানেলগুলো দেশের কল্যাণকামী মানুষের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে জনগণের নানাবিধ চাহিদা পূরণ তথা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে দেশ, জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন রচনা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এসব টিভি চ্যানেলগুলোর দরুন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর সচিত্র প্রতিবেদনসহ মুহূর্তের মধ্যেই সর্বশেষ তথ্য ও ছবি দেখতে পারছি। যার মাধ্যমে অতিসহজেই জনগণ প্রবহমান বিভিন্ন ঘটনার উপর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

অন্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলো যখন বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে নিজ নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ঠিক রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং ওইসব দেশের জনগণের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নের পাশাপাশি নিজ নিজ সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জাতীয় জীবনে অগ্রগতি সাধন করছে। পক্ষান্তরে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে দেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রসার হলেও আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেশীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচারে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। দেশে টিভি চ্যানেলগুলো তথ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারি ও হাতে গোনা কিছু বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছাড়া প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেল ক্যাবল অপারেটরদের অনৈতিক অর্থ উপার্জন কখনো কখনো অনুষ্ঠান সম্প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। যা অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিকাশে অন্তরায়। এর ফলে একদিকে উদ্যোক্তাগণ হচ্ছে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং জনগণ হচ্ছে দেশীয় তথ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। যদিও এদেশের ক্যাবল অপারেটরদের উচিত দেশীয় সকল চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশীয় তথ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া এবং এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা। তা না করে অনৈতিক মুনাফা লাভের আশায় এবং সঠিক নীতিমালা না থাকায় ক্যাবল অপারেটররা তাদের ইচ্ছামতো দেশীয় চ্যানেল বাদ দিয়ে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে, যা কাম্য নয় । ফলে দেশি চ্যানেলে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণা থেকে ক্রমেই এদেশের জনগণ পিছিয়ে পড়ছে এবং বিদেশি চ্যানেলগুলোর ওপর দিন দিন আরো অধিক আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অনুপস্থিতিতে বিদেশি ছবি ও বিজাতীয় সংস্কৃতিনির্ভর অনুষ্ঠান বেশি প্রদর্শিত হচ্ছে। বিদেশি চ্যানেলগুলোর ধারাবাহিক সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শিশুদের নিজ ভাষার চাইতে বিদেশি, বিশেষ করে হিন্দি ভাষা অথবা অন্য ভাষায় তাদের যেমন আসক্ত করছে, পাশাপাশি দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজকেও ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে।

বর্তমানে বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলের রসাল অনুষ্ঠান দেখে আমরা সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অতীত ধ্যান-ধারণা, নারী-পুরুষের আদি সম্পর্কসহ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারগুলো হারাতে বসেছি, যা মানবিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। তথ্যসেবার নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির এই গোলক ধাঁধায় আমরা পূর্ব-পুরুষের সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে হটিয়ে ভোগবাদী পণ্য-সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুঁকছি। যা বর্তমানে তরুণ প্রজন্মকে যৌন ও বিভিন্ন অপরাধ নির্ভর পশ্চাৎমুখী মূল্যবোধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ক্যাবল অপারেটরদের দ্বারা বিদেশি চ্যানেল অধিক প্রচারের কারণে এই প্রবণতা শহর থেকে গ্রামেও গিয়ে পৌঁছেছে। এর পরিণতিতে ব্যাপকভাবে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা ও জনবিচ্ছিন্নতা। আর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানুষের মূল্যবোধের ওপর। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। এই মূল্যবোধহীন বিদেশি অনুষ্ঠানগুলো নারী-পুরুষের চিরন্তন সামাজিক বন্ধনেও চির ধরাচ্ছে । এতে ভাঙছে পরিবার, বাড়ছে স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদ, মানুষ হচ্ছে নিঃসঙ্গ ও আগামী প্রজন্ম আসছে শিকড়বিহীন।

আমরা আশা করবো দেশ, মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি, অতীত ঐতিহ্য রক্ষায় দেশীয় চ্যানেলগুলোর প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক ক্যাবল অপারেটরদের সকল চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্র্রচারে বাধ্য করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন অধিক জরুরি। ক্যাবল অপারেটররা দেশীয় সকল চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী জ্ঞাননির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ বিদেশি অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে দেশি টিভি চ্যানেলগুলোকে বিদেশি চ্যানেলে প্রচারিতব্য অনুষ্ঠানাদির চাইতে আরো মানসম্পূর্ন অনুষ্ঠান তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অধিক বিজ্ঞাপন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। কেননা অনুষ্ঠানের ভেতর অধিক বিজ্ঞাপন প্রচার করায় সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখায় দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটা প্রতিকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি।

সর্বোপরি দেশ ও জনগণের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সামগ্রিক উন্নয়নে স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য দেশীয় টিভি চ্যানেলগুরোকে আরো অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে। শিশুদের জন্য বিনোদনধর্মী শিক্ষা বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় মজার মজার অনুষ্ঠান ও কাটুন চ্যানেল রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমে দেশীয় চ্যানেলগুলোর প্রচার ও প্রসার বাড়াতে পারলে কিছুটা হলেও বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলোর আগ্রাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে। এক্ষেত্রে টিভি চ্যানেল উদ্যোক্তাদের দেশীয় দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী ভাল ভাল অনুষ্ঠান তৈরি করতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। এর ফলে এই পেশায় সংশ্লিষ্টদের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের কিছু বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের সকল ক্যাবল অপারেটরদের নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালনার জন্য এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর অধিক প্রচার ও প্রসারে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। যদিও বর্তমান সরকার দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই অতিদ্রুত এর সফল বাস্তবায়ন। যা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর বিদ্যমান সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করবে। বর্তমান সরকার যখন দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর সেই মুহূর্তে তথ্যপ্রবাহের প্রধান বাহক আমাদের দেশের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্যাবল অপারেটরদের অনৈতিক অর্থ উপার্জনে তাদের হাতে জিম্মি। এবং তা দ্রুত মুক্ত করতে হবে। এই যদি আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নমুনা হয় তবে কতদিন নাগাদ দেশকে একটি সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাই দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অবাধ তথ্যপ্রবাহ প্রচার নিশ্চিত করতে এবং বিদেশি টিভি চ্যানেলের আগ্রাসন থেকে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অংশীদারির ভিত্তিতে আলোচনা সাপেক্ষে দেশের সকল ক্যাবল অপারেটরদের জন্য সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত নীতিমালা গ্রহণে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছা কামনা করছি। আমরা আশা করব, সকলের মতামতের ভিত্তিতে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য চূড়ান্ত নীতিমালা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে সরকার, ক্যাবল অপারেটর তথা সংশ্লিষ্টদের সার্বিক সহযোগিতা জাতি আশা করে।

লেখক : কলাম লেখক।

(এমএআর/এনডি/অক্টোবর ২৬, ২০১৪)