ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও উন্নত সমৃদ্ধ দেশের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে তার নেওয়া পদক্ষেপের বস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখে চলা অবদান সারা বিশ্বেই প্রশংসিত। ১৭ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য দিন। এটি শুধু শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস নয়, এটি বাংলাদেশের পুনর্জাগরণের দিন। এ বছর ১৭ মে বাংলাদেশের আরেকটি অনন্য অর্জন এলো জাতিসংঘের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ পেল বৈশ্বিক স্বীকৃতি। বুধবার জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি রেজ্যুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। 

‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা : সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজ্যুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে 'দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ' হিসেবে উল্লেখ করে।

এটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায় সাম্য আনয়নে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।

মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদে রেজুলেশনটি উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবদুল মুহিত। কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনস্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি সদস্য রাষ্ট্র এই রেজুলেশনটি কো-স্পন্সর করে।

রাষ্ট্রদূত মুহিত তার বক্তব্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনে এই রেজুলেশনের ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এই রেজুলেশনের অনুমোদনকে ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন।রেজুলেশনটির সফল বাস্তবায়ন কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের পক্ষ থেকে রেজুলেশনটি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোশিয়েশন করেন উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মো. মনোয়ার হোসেন। মিশন গত কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এর ধারাবাহিকতায় এই রেজুলেশনটি এই বছরের শুরুর দিকে মিশন সদস্য রাষ্ট্রের বিবেচনার জন্য প্রস্তাব করে।

সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিগত ৪ মাস নিবিড় আলোচনা ও নেগোশিয়েশনের পরে মঙ্গলবার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে।স্বাধীনতার পর দেশের প্রকৃত গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা সবচেয়ে সফল উদ্যোগ। কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে স্বাস্থ্য সেবা। মা ও শিশুর পাশাপাশি প্রান্তিক জনপদের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এই ক্লিনিক।

কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৃণমূলে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভূতপুর্ব ধারণার রুপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি তার স্বকীয় উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। দেশ-বিদেশের এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের অভিনব ধারণা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।

মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলো আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমেই দেশের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, যার ফলে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের জনগণের বিশাল একটি অংশ। অনেক দেশ তৃণমুল পর্যায়ে তাদের স্বাস্থ্য সেবায় এ মডেল অনুকরণ করছে। তৃণমূল স্বাস্থসেবায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ বাংলাদেশের এই কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাটি নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরের সময় গ্রামে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার একটি পুস্তিকার নাম– কমিউনিটি ক্লিনিক- হেলথ রেভ্যুলেশন ইন বাংলাদেশ।

ইতিহাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগুলো ছিল মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক। অথচ সে সময় ৮৫% মানুষ গ্রামে বাস করতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র ৩ বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু ৭৫ এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তিনি সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দিকে আর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই জাতির জনকের কন্যা পিতার স্বপ্ন – ‘সবাই জন্য স্বাস্থ্য সেবা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। জন্ম দেন অভিনব ধারণা কমিউনিটি ক্লিনিক । প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৪ হাজার ৪৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়। ২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়।

কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয় তৃণমূলের জনগণের জন্য কল্যাণকর এই সফল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমটি। বিএনপি-জামাত জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ক্লিনিকগুলো। নষ্ট হয়ে যায় অনেক ভবন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল ক্লিনিকগুলো।

২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম চালু করে। এ সময়ে ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার-সিএইচসিপি নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিত্যক্ত ব্যবহার অযোগ্য ভবনগুলো সংস্কার ও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে। দ্রুত বাড়তে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা। বর্তমানে ১৪ হাজার ২০০টি ক্লিনিক চালু রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ১৪হাজার ৮৯০টি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

আইনি কাঠামো

২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার আবারো ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৮ সালে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-২০১৮’ নামে একটি আইন করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এটি সংসদে পাশ হয়। আইন পাশের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন হয়। ২০১৮ সালেই ১৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড হয়। এতে একটি উপদেষ্টা পরিষদেরও বিধান রাখা হয়। যার সভাপতি স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এই আইন ও স্ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ফলে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিতের জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

নির্মাণ

গ্রামীণ সড়কের পাশে প্রায়ই চোখে পড়ে একেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় একই নকশায় তৈরি ছোট্ট ভবনে এই ক্লিনিক। গ্রামীণ জনপদের প্রতি ৬০০০ মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটার দুরত্বে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে এমন পরিকল্পনায় ক্লিনিকগুলোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষের দান করা জমিতে এসব ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। প্রথম দিকে ৫ শতাংশ জায়গায় ক্লিনিকগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। এ জন্য এখন ৮ শতাংশ জমির ওপর নতুন মডেলের ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ভবনে চারটি করে রুম। দুটি স্বাস্থ্যকর্মীদের বসার জন্য, একটি রোগীদের ওয়েটিং রুম, আরেকটি লেবার (ডেলিভারি) রুম। বাথরুম থাকছে দুটি। আধুনিক মানের একটি ক্লিনিক হিসেবে গড়ে উঠছে প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতরের এসব ক্লিনিক। প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা শেখ হাসিনা নিজেই এর নকশা অনুমোদন করে দিয়েছেন। ক্লিনিক ভবনের সর্বশেষ স্থাপত্যশৈলী খুবই নান্দনিক এবং আকর্ষণীয়।

পরিচালনা

গ্রামের মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিটি চালায় কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য রয়েছে ১৭ সদস্যের কমিউনিটি গ্রুপ- সিজি। সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ নিয়ে এটি গঠিত। গ্রুপে ন্যূনতম চারজন নারী সদস্য থাকেন। এই গ্রুপের প্রধান থাকেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য। আর জমিদাতা থাকেন ভাইস চেয়ারম্যান। উপদেষ্টা হিসেবে থাকেন স্থানীয় চেয়ারম্যান। আবার সিজিকে সহযোগিতা করার জন্য থাকে ১৭ সদস্যের কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ।

কমিউনিটি ক্লিনিকের অনন্য দিক হচ্ছে কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণের এই ব্যবস্থা একটি মডেল। এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যসেবার পরিচালনায় যুক্ত হতে পেরে নিজেদের ক্ষমতায়িত মনে করে। এই দুই গ্রুপের নজরদারির কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকে একধরনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়েছে। মানুষ ক্লিনিকগুলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে।

অর্থায়ন ও সহায়তা

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে যাতে কমিউনিটি ক্লিনিক সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে; সেজন্য জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্ট আইন-২০১৮ পাস হয়েছে। এতে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ট্রাস্টকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার প্রকল্প থেকে। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সরকার প্রতি বছর ২৫০ কোটি টাকার ওষুধ দেয় ইডিসিএল থেকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, জাইকা, ইউনিসেফ ইত্যাদি সংস্থা আর্থিক, কারিগরি ও লজিস্টিক সরবরাহের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান উন্নয়নে কাজ করছে।

কারা সেবা দেন

‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানে পরিচালিত এসব ক্লিনিকে কাজ করেন স্থানীয়রাই। প্রতিটি ক্লিনিকে তিনজন সেবাকর্মী আছেন। মূল দায়িত্বে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার- সিএইচসিপি। এই পদের জন্য নারী ও এলাকার মানুষকেই সরকার প্রাধান্য দিয়েছে। সিএইচসিপির সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিকে থাকেন। তাকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মী, যাকে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে সবাই চেনেন। তিনি তিনদিন ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা দেন। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য মাঠকর্মী, পরিবারকল্যাণ মাঠকর্মী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তিনদিন ক্লিনিকে সেবা দেন। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই সকাল ৯ টা থেকে বেলা ৩টা পর্য়ন্ত সেবা দেওয়া হয় ক্লিনিকে।

কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে আরেকটি নমুনা কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। প্রতিটি ক্লিনিক সংলগ্ন এলাকার ২৫০ থেকে ৩০০ পরিবারের জন্য একজন করে মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে ৭০ হাজার ভলান্টিয়ার দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের আছে। এদের মাধ্যমে ক্লিনিকসংলগ্ন বাড়িগুলোর সদস্যদের স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে। শেখ হাসিনা সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এই ক্লিনিকগুলো। এগুলোই হবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যানের তথ্যভান্ডার।

কি কি সেবা দেওয়া হয়

গ্রামীণ জনগনের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়ার প্রথম স্তর হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার এগুলো। এখানে বিনামূল্যে প্রাথমিকভাবে সকল রোগের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়।

* ক্লিনিকগুলোতে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় গর্ভবর্তী মহিলাদের প্রসব পূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসব পরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা দেওয়া হয়।

* এই ক্লিনিকগুলোতে সময়মত প্রতিষেধক টিকা (যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি) এবং শিশু ও কিশোর কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়।

* জনগণের জন্য বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূর করার জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেবা দেওয়া হয়।

* ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে ক্লিনিকগুলোতে।

* সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা,পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানী, চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

* অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমন-কনডম, পিল, ইসিপি ইত্যাদি সার্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ করা হয়।

* জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়।

* সদ্য বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিবন্ধিকরণ ও সম্ভাব্য প্রসব তারিখ সংরক্ষণ করা হয়।

* মহিলা ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা সনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

* শুরুতে কমিউনিটি ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা ছিল না। তবে এখন দেশের প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করানোর সেবা দেওয়া হচ্ছে।

* কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষকে বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। অসচ্ছল ও দরিদ্র ডায়াবেটিক রোগীরা বিনামূল্যে ইনসুলিনও পাচ্ছেন।

উপকারভোগী

বাড়ির কাছেই সহজে, বিনামূল্যে নির্ভরযোগ্য, আস্থাশীল সেবা পাওয়ার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পরিবারের হাসপাতাল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লিনিকে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকারও বেশি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। গত জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ক্লিনিকগুলোতে মোট ভিজিট হয়েছে ১০৬,৩৫৩,৭২৯ টি অর্থাৎ প্রায় ১০০ সাড়ে সাতকোটিরও বেশি। ১০ কোটিরও বেশি মানুষ পেয়েছেন বিনামূল্যের এই স্বাস্থ্যসেবা। প্রতিদিন প্রতিটি ক্লিনিকে ৭চ-৮০ জনেরও বেশি ভিজিট করেন। এর ৮০% নারী ও শিশু। এ পর্যন্ত ৪০০০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রায় এক লক্ষ মায়ের নিরাপদ স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে। ৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি রোগীকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে জরুরি ও জটিলতার কারণে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।

উপকারভোগীদের সন্তুষ্টি

গ্রামাঞ্চলে আগে হাসপাতাল-ক্লিনিক তো দূরের কথা ভালো ওষুধের দোকানও পাওয়া যেত না। কিন্তু কমিউনিটি ক্লিনিক এর সুবাদে এখন বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা, পরামর্শ ও অষুধ পাচ্ছেন ঘরের কাছেই। দিন দিন এর সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়ছে। সরকারের পৃথক দুটি জরিপেও এসব ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) এর এক জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষই সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর জরিপে দেখা যায়, সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। প্রান্তিক মানুষ এখন স্বাস্থ্যসেবার আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে। ক্লিনিক করার জন্য জমি দান করতে অসংখ্য মানুষ আবেদন জমা দিচ্ছেন।

ফলাফল

কমিউনিটি ক্লিনিক দেশের স্বাস্থ্য সেবায় বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চিকিৎসার ক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি বদলে দিয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার সামগ্রিক চিত্র। গত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ইতিবাচক উন্নতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার কমেছে ২৯ শতাংশ। জন্মহার নেমে এসেছে ২.৩ এ। শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৫৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাতৃগর্ভে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা এখন ৬৪ শতাংশ, কম ওজনের শিশুর জন্মের হার নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশে। প্রসবকালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা নেওয়ার হার ৪২ শতাংশ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের প্রবণতা ৬২ শতাংশ এবং হামের টিকা গ্রহণের প্রবণতা দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। ২৩ মাসের মধ্যে সবগুলো মৌলিক টিকা গ্রহণের হার এখন ৮৪ শতাংশ। এসব অগ্রগতিতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে।

স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রায় সব সূচকে তলানিতে ছিল বাংলাদেশ। সেই দেশ এখন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য সেবায় টপকে গেছে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরো বহু দেশকে। কমিউনিটি ক্লিনিক দেশের সর্বিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। আমাদের যে অর্জনগুলোকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি।

পরিশেষে বলতে চাই, সাধারণত, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলি মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং রেফারেল পরিষেবা প্রদান করে থাকে। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে সবার জন্য সহজলভ্য করতে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরই পরম্পরায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় " প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।এই জন্য বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে।তাই শেখ হাসিনার যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি এনে দিয়েছে। সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করি। । দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহতভাবে দূর্বার গতিতে তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে যাক। তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প চিরস্থায়ী হোক।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।