আম্বিয়া বেগম অন্তরা : একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে লেখার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু এই অক্টোবর মাস এলেই সেই হৃদয় বিদারক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেই স্মৃতি আমার বোন রওশন আরা যাদুর মুখে শোনা।

ওই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমারই দুলাভাই, বোন রওশন আরা যাদুর স্বামী। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম খাইরুল ইসলাম। পিতা মরহুম খেলাফত মণ্ডল। গ্রাম মজলিসপুর, জিলা চুয়াডাঙ্গা। মেহেরপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে মেহেরপুর কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। ওই অবস্থাতেই আমার চতুর্থ বোন রওশন আরা বেগম ওরফে যাদুর সাথে বিয়ে হয় খাইরুলের। বিয়ের মাত্র চার মাস পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আমার খাইরুল দুলা ভাই যুদ্ধে চলে যান। ভৈরব নদ ঘেঁষা মেহেরপুর থানা এলাকাতেই তিনি যুদ্ধ করেছেন। তার সাথে ছিলেন অনেক সহযোদ্ধা। একাত্তরের অক্টোবরে খাইরুল দুলাভাই পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারপর শুরু হয় হৃদয় বিদারক নির্যাতন। মেহেরপুর থানায় আটকে পিটমোড়া করে বেঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে তার হাতের দুই কনুইয়ের হাড় ভেঙে দেয় পাকসেনারা। সহযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা বলতে অস্বীকার করায় খাইরুল দুলাভাইয়ের সারা শরীর ব্লেড দিয়ে কেটে ক্ষত জায়গায় লেবু আর লবন মিশিয়ে দেয়া হতো। যখন যন্ত্রনায় খুব চিৎকার করতেন খাইরুল দুলাভাই তখন হানাদার পাকসেনারা মেহেরপুর থানার পাশেই ভৈরব নদে তাকে চুবিয়ে রাখতো। এই সব খবর যখন আমার বোন যাদুর কানে কিছু লোকের মাধ্যমে পৌঁছাতো, তখন সে দুলাভাইকে দেখার জন্য কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আমাদের পাড়ার মকবুল রাজাকার খাইরুল দুলাভাইকে দেখতে যেতে নিষেধ করতো। মকবুল রাজাকার বলতো, যাদু সেখানে গেলে পাক সেনারা তাকে আটক করে পাশবিক নির্যাতন করবে। মকবুল যদিও রাজাকার, তবু ওই সময় আমার বোনকে সম্ভ্রমহানি থেকে বাঁচিয়েছে।

আমার খাইরুল দুলাভাই আর ফিরে আসেননি। তার লাশটাও পাওয়া যায়নি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আমার বোন কোনও সম্মানও পায়নি।এ নিয়ে সরকারের কাছে কোনও অভিযোগও নেই। পরিতাপ হয়, আসল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান স্বীকৃতি নেই, অথচ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা মোটা টাকা মাসোহারা পাচ্ছে ! তাদের সন্তানরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে পাচ্ছে চাকুরি ! এই লজ্জা কার ?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।