রহিম আব্দুর রহিম


ছয় বছর আগের ঘটনা। শাকিল নামের এক তরুণ খেলোয়াড় আমাকে ওদের বাসায় দাওয়াত করলো। সে কি আয়োজন। আলোচনা হলো শাকিলের বাবা নজরুল ইসলামের  দুইটি কিডনি ড্যামেস হয়েছে। আমি মনে করেছি, বাবার রোগমুক্তির জন্য দোয়া চাইতে শাকিল আমাকে দাওয়াত করেছে; মনে করার কারণ, আমি মাদ্রাসার শিক্ষক। মহাবেকায়দায় পড়লাম, তাদের বোঝালাম আমি তো হুজুর না, মোনাজাতের জন্য কোন হুজুরকে আনুন। খাবার টেবিলের সবাই হু হু করে হেসে উঠল। বললাম হাসছেন কেনো? এবার জানলাম শাকিলের বাবাকে চেন্নাই এ্যাপোল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ডাক্তার বলেছেন, 'খুব জটিল অবস্থা। বেশীদিন বাঁচবে না। আমরা কোনদিন ভারতে যায় নি, তাই আপনাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।'

শাকিলের বাবা নজরুল ইসলাম মাংস ব্যবসায়ী। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে শাকিল ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র (বর্তমানে হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত )। মেয়ে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে। চাষাবাদের কোন জমি জায়গা নেই।শহরের বাড়ি ভাড়া দিয়ে মাসে যে টাকা পান, তার সাথে যুক্ত হয় ব্যবসায়ী আয়ের অর্থ। এতে দুই সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার, পারিবারিক বরণ-পোষণসহ তাঁদের সুখের সংসার। সংসার কর্তার কিডনি ড্যামেস হওয়ায় তাঁকে চেন্নাই যেতে হবে। শহরে বাড়ির একাংশ বিক্রি করার শর্তে এক ব্যক্তির কাজ থেকে লাখ তিনেক টাকা সংগ্রহ করেছেন। দিনক্ষণ ঠিক হলো।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস। ভারতের শিলিগুড়ি বাগডোকরা বিমানবন্দরে থেকে বিমানে চেন্নাই। রাতে উঠে গেলাম চেন্নাইয়ের এ্যাপোলো হাসপাতালের অনতিদূরের এক আবাসনে। সকালে হাসপাতালের রোগী নিবন্ধন শাখায়। বললাম, আমাদের রোগীর কিডনি সমস্যা। শাখা থেকে বললেন, যেই রোগই হোক না কেনো প্রথমে মেডিসিন বিভাগে নিবন্ধন করাতে হবে। তাই করা হলো। ছ'শ টাকা ভিজিট। চিকিৎসকের কাছে যাবার আগেই এক মহিলা টানা পয়তাল্লিশ মিনিট রোগীর একাল সেকাল জানলো, নোট করলো। এর ঘন্টা দু'য়েক পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। রোগীর সাথে আমি, তার স্ত্রী এবং সন্তান শাকিল, সাথে ডাক্তারের সহযোগী। ডাক্তার এবার নতুন করে রোগের কাহিনী শোনা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে প্রাপ্ত উত্তর নোট করছেন।

এখানে প্রায় ৩০মিনিট, চরম অধৈর্য, সীমাহীন বিরক্তি। রোগীর কাছ থেকে সহযোগী ও চিকিৎসক যে গল্প শুনেছিলেন, তা তারা মিলিয়ে নিলেন। এবার তিনি ওই হাসপাতালের পরের একটি বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার এক ডাক্তারের কাছে পাঠালেন। নতুন করে আর কোন ভিজিট নেই। বেলা গড়িয়ে দুপুর। এখানে আবার কাহিনী শুরু হলো।ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। শেষমেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা জন্য একটা প্রেসকাইভ ধরিয়ে দিলেন। এবার ক্যাশ শাখায় ডাক্তারের ভিজিট, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি প্রদান করা হলো। তবে আজ আর হবে না, পরের দিন। তাই হলো। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু ল্যাবে দিয়ে আসা হলো।পরের দিন রিপোর্ট সংগ্রহ করে আবার ডাক্তারের কাছে, আজ আরও একটা পরীক্ষার জন্য লেখলেন। এই হাসপাতালের যান্ত্রিক ত্রুটি, ফলে বাইরে থেকে করাতে হবে। আমরা সেখানেই গেলাম।

এদিকে প্রথমদিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হওয়ায় আমরা ফিরতে টিকেট করে ফেলেছি। পরেরদিন ১১টায় বিমান। ডাক্তারকে ঘটনা জানালাম। তিনি জানালেন "রিপোর্ট নিয়ে আসুন, রাত যতই হোক, রিপোর্ট দেখবেন। সন্ধা হয়ে গেছে। রিপোর্ট নিয়ে আসলাম, ডাক্তার সিট ছেড়েছেন। আমরা বিষয়টি জানালাম ওই শাখার এক সেবককে। তিনি ডাক্তারকে ফোন দিলেন, ২০ মিনিটের মধ্যে আবারও তিনি আসলেন। সবকিছু দেখে তিনি মুচকি হেসে বললেন, নো প্রোবলেম, একটা বাল্ব ছোট হয়ে গেছে। বেশি করে পানি খাবেন। এবার রোগীর স্ত্রী, শাকিলের মা ডাক্তারকে বললেন। স্যার 'দাওয়াই'(ওষুধ) দেবেন না। এবার ডাক্তার রেগে গিয়ে কপাল চাপড়িয়ে বারবার বলতে লাগলেন ওহ্ বাঙালি! বাঙলি! বাঙালি!বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ভাষায় পারদর্শী হালকা পাতলা চেহারার এই ডাক্তারের নাম 'কে সি প্রকাশ'(Dr. K. C.Prakash,Consultant Nephrology) ।'

এই কয়দিনে তাঁকে প্রচন্ড বিরক্ত করেছি, সে রাগে নি, শেষদিন তাঁকে রাগান্বিত দেখে সাহস করে বললাম, স্যার আপনাকে যেভাবে বিরক্ত করেছি, আপনি রাগ করেন নি,আজ কেনো রেগে গেলেন?তিনি উত্তর দিলেন 'এই পৃথিবীতে ভগবানের পর, মানুষ দু'জনের উপর বিশ্বাস রাখেন,তার প্রথমজন ডাক্তার, দ্বিতীয়জন বিচারক। চিকিৎসক রেগে গেলে মানুষ যাবে কোথায়?' এবার সুযোগ বুঝে বললাম, তাহলে স্যার বাঙালি বলে অবজ্ঞা করলেন কেনো? তখন তিনি বললেন, 'ওষুধ খাওয়াটাও যে একটা রোগ, তা বাঙালিরা বুঝেন না।' এবার তিনি জানতে চাইলে আমার পেশা, রোগী আমার কি হোন।জানালাম, পেশায় শিক্ষক, নেশায় লেখক। রোগীর ছেলে আমার ছাত্র, আমি রোগীর দালাল নই। দাঁড়িয়ে নম্বষ্কার জানিয়ে বিদায় দিলেন।

নজরুল সুস্থ আছেন। তবে তাঁর সর্দি হলেও তিনি ভারত চিকিৎসা নেন। কারণ...! কামরুজ্জামান নামের এক রোগীর কোমর ও বাহুর ব্যথা বেড়ে গেলো। সে তার এলাকার নামীদামী ক্লিনিকে বসেন এক অর্থোপেডিক ডাক্তারে কাছে গেলেন, ডাক্তারের মধুর আচরণে মুগ্ধ হলেন। ওষুধ লেখে দিলেন, সাতদিন পর তাঁকে আবার যেতে বললেন। টানা তিনদিন ওষুধ সেবন করার পর তার ব্যথা কমছে না, বরং বেড়েছে কয়েকগুণ। এবার তিনি ডাক্তারের কাজে গেলেন বিষয়টি জানানোর জন্য, ডাক্তার এই রোগীর উপর এমন ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপেছেন যে, পারলে তাকে মারে। কারণ, সাতদিন পরে যেতে বলেছেন, রোগী কেনো তিনদিন পর গেলেন। এই রোগী পরে ভারতে চিকিৎসা হয়েছেন, অসুস্থ হলেই তিনি পাশের দেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন।

সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে বসবাসকারী ফজলুল হক (২৮), পেশায় ডে-লেবার। ওর কোমরে ব্যথা, ভাতের মত ওষুধ খাচ্ছে, ব্যথা কমে না। ডাক্তার তাকে অপারেশন করতে বলেছেন। ওর পাশের বাড়ি আনিছুর (২৯) ভ্যান চালক, দুর্ঘটনায় তার ডান পায়ের হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছিলো, বর্তমানে বেড়েছে। প্রতিদিন ওষুধ খাচ্ছে ব্যথা কমার লক্ষণ নেই। ওরা দু'জন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত যাবে। পাসপোর্ট ভিসা প্রস্তুত। সঙ্গী খুঁজছে, পেয়েও যায়, নুরুজ্জামান নিষাত নামের একজনকে। ওইদলে আমি এবং নিষাতের ছোট ভাই নাবিল। ভ্রমণের ফাঁকে সবাই কলিকাতার আইরিশ হাসপাতালের ইউরোলজিস্ট সৌরভ চক্রবর্তীর কাছে চিকিৎসা নেবো, এই চিকিৎসাকে খুঁজে পাওয়ার পেছনের কাহিনী আরও মজার মো. মোশারফ হোসেন পুলিশ বিভাগের অবসর প্রাপ্ত গাড়ি চালক। চার বছর আগে ঘটনা, তাঁর পায়ে ব্যথা, সে বিভিন্ন স্থানে ডাক্তার দেখিয়েছেন। কাজ হয়নি; পরে তিনি তাঁর এক ভাইকে নিয়ে কলিকাতার আইরিশ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার ভাস্বরের কাছে চিকিৎসা নেন। দু'প্রকার ওষুধ এক বছর খেতে বলেছিলেন। চারমাসেই তিনি সুস্থ। এখনও যিনি ভালো আছেন। তাঁর দেওয়া ঠিকানা ধরে কলিকাতায়।

২৪ এপ্রিল ভারত পৌঁছালাম, ২৬ এপ্রিল হাসপাতালে। জানলাম ডাক্তার ভাস্বর দু'বছর আগে মারা গেছেন। আমরা চিন্তিত, উপায়! খুঁজে পেলাম ডাক্তার সৌরভ চক্রবর্তীকে। ভিজিট ছয়শত টাকা, দেখলেন। ওষুধ লেখার পর বললেন, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে। করে নিলাম। এই ছয়'শ টাকায় আমাদের তিনদিনে তিনবার দেখলেন। বর্তমানে ব্যথার দুই রোগীই ৭০ ভাগ সুস্থ। নাবিলের সুস্থতা ৬০ শতাংশ।

আমার কর্মস্থল পঞ্চগড়ের সন্তান ডাক্তার তোফায়েল আহমেদ। এই ছেলে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী থাকাকালের তুখোড় বিতার্কিক, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং জাতীয় পর্যায়ের কয়েকবার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। আমার সংগঠনের সদস্য। সে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক। কয়েক মাস আগে আমি ঢাকায় গিয়ে তার কাছে চিকিৎসা নিয়েছি। সে আমাকে ওই হাসপাতালে নিউরোমেডিসিন বিভাগের মু. মাছউদ আলমের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করান। ভারতের চিকিৎসক সৌরভ চক্রবর্তী তাঁর দেওয়া চিকিৎসাপত্র দেখে মন্তব্য করেন, 'ঠিকঠিক।'

৩০ এপ্রিল ভারত থেকে ফেয়ার পথে 'ফুলবাড়ি,- বাংলাবান্ধা' ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে কথা হয় রংপুরের এক হার্ডের রোগীর সাথে।দেশের কোন এক ডাক্তার নাকি তাঁকে বাইপাস সার্জারি করতে বলেছেন। উনি সিদ্ধান্ত নেন, যদি তা করতে হয়, তবে ডাক্তার দেবী শেঠীর কাছে গিয়ে করবে। যে কথা, সেই কাজ। চলে যান ভারতে। দেবী শেঠী তাঁকে চিকিৎসার প্রারম্ভেই তিনতলা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির বেয়ে উপরে উঠতে এবং নামতে বলেন। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী উনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেন, নামার পথে তিনি দেখেন দেবী শেঠী সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানেই রোগীর সাথে তিনি কথা বলেন। "আপনার কোন সমস্যা নেই, দেশে চলে যান।"

ভারতের এক রাজ্য বা প্রদেশের চিকিৎসকের চিকিৎসা পত্রে সারা ভারতে ফার্মেসীগুলোতে ওষুধ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এক বিভাগের চিকিৎসাপত্রে অন্য বিভাগের ফার্মেসীগুলো ওষুধ পাওয়া দুষ্কর।বাংলাদেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে ওষুধ কোম্পানির ভিজিটরদের যে ভীড় থাকে, তা বিশ্বের আর কোথাও নেই। চিকিৎসা সেবায় আমাদের শত ঘটনায় শত প্রশ্ন। কেনো এমনটি হচ্ছে? তবে কি আমাদের ডাক্তাররা চিকিৎসা বুঝেন না, নাকি ওষুধের মানগুণ দুর্বল? চিকিৎসক কি রোগীর, নাকি কোম্পানীর? রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যকার সম্পর্ক কি হওয়া দরকার, হচ্ছেটা কি?

আমি ব্যক্তিগত ভাবে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি এবং বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা, চিকিৎসা শাস্ত্রে অত্যন্ত দক্ষ, প্রাজ্ঞ এবং পারদর্শী। তার একটি উদাহরণ, আমার (শিক্ষা জীবন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকাল থেকে ঘণ ঘণ জ্বর হতো। ওষুধ খেতাম কমে যেতো,আবার হতো। এই জ্বর কর্মজীবনে জামালপুর, চাঁদপুর, সর্বোপরি বর্তমান কর্মস্থলেও একই ভাবে হয়েছে। এখানকার অধীন্দ্রনাথ নামের এক ডাক্তার কাছে গেলাম, তিনি রোগের কাহিনী শুনলেন, পরে বললেন, আপনি কি পরনের শার্টের নিচে গেঞ্জি পরেন কি না? বললাম হ্যা, তিনি বললেন এটা আর পড়বেন না। তাই করলাম। আজ প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে ওই জ্বর হচ্ছে না। পরে তাঁর কাছে জেনেছি, 'শরীরের ঘামে গেঞ্জি ভিজে তা ঠান্ডা হয়ে শরীরে বসে যাওয়ার কারণে এই জ্বর হতো।' তিনি আমাকে বলেছেন, গরমে, গরম পানীয়, শীতে ঠান্ডা পান করবেন। অসুবিধা হলে নরমাল। আমি তাই করছি। বাংলাদেশ থেকে রোগীদের বিদেশ ঠেকাতে আমাদের প্রাজ্ঞ, দক্ষ প্রাণসেবী চিকিৎসকরা কবে, কি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন তা দেখা এখন সময়ের দাবী।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।