জাবি প্রতিনিধি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে আশংকাজনক হারে এখানে অতিথি পাখির পরিমাণ কমেছে।কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত বিভিন্ন ভবন নির্মাণ, সময়মত লেকগুলো সংস্কার না করা, আবহাওয়া পরিবর্তন, গাছকাটা, লেক লিজ দেওয়া, বহিরাগতদের উৎপাতসহ নানা অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার প্ল্যানের আওতায় ২৩টি প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। তার মধ্যে অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে আবার অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক গাছ কাটতে হয়েছে যা অতিথি পাখির জন্য হুমকি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের ভাষ্যমতে, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য অনেক জায়গায় গাছ কাটা পড়ছে যা পাখিদের বাসস্থান ও বংশবিস্তারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর লেকের পাশের গাছগুলো বাচ্চা দেওয়ার মতো ততোটা উপযোগী নয়। এই জায়গাগুলো ছাড়া বাকী যেই জায়গাগুলো রয়েছে সেগুলো যদি রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, আরও বেশি পরিমানে গাছ লাগানো যায় তাহলে সবুজের পরিমাণ বাড়বে, তখন ক্যাম্পাস পাখি থাকার উপযোগী হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বহিরাগতদের অবাধে বিচরণ, গাড়ির উচ্চ শব্দ ইত্যাদি সমস্যার ফলে বর্তমানে অতিথি পাখি লেকগুলোতে কম দেখা যায়।

পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মঈম হাসান বলেন, “বর্তমানে আগের মতো আর পাখি দেখা যায় না। আমরা প্রথম বর্ষে যখন এই ক্যাম্পাসে আসি তখনও পাখির সংখ্যা ছিল অনেক কিন্তু দিন দিন সেই সংখ্যা কমেছে। কেনো কমেছে তা বলতে পারব না; অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আবহাওয়ার পরিবর্তন, জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট, বহিরাগত ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের উৎপাত হয়তো পাখিদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হতে পারে।”

প্রশাসনের ভূমিকাও এখানে অপ্রতুল বলে দাবি করেছেন এই শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (এস্টেট) আব্দুর রহমান বলেন, “ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বাজেটে অতিথি পাখি ও লেক নিয়ে আলাদা কোনও বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ক্যাম্পাস উন্নয়ন খাতের মধ্যেই এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতি বছর বর্ষাকালে পলি মাটি, আবর্জনা ও অন্যান্য কারণে লেকগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ২০১২-১৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের সময়ে কাবিখার অন্তর্ভুক্ত একটি বরাদ্দ থেকে লেক সংস্কারের জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়। তখন লেক সংস্কার করা হলেও পরে টাকার অভাবে লেক সংস্কার করা হয়নি। পরবর্তীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জাবি প্রশাসনিক অফিস থেকে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হলেও তাআরপাওয়াযায়নি।”

আব্দুর রহমান আরও জানান, প্রতিবছর অক্টোবর মাসে লেকগুলো পরিষ্কার করতে হয়। এজন্য বাহির থেকে ঘন্টা বা দিন হিসেবে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নেওয়াহয়। গতবছর অর্থের অভাবে লেকগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।

ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটা লেক অর্থের বিনিময়ে লিজ দেয়া হয়েছে যার ফলে লেকগুলোতে উন্মুক্তভাবে পাখি বিচরণ, খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদিতে বাঁধা সৃষ্টি করেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “যেসব লেকগুলোতে পাখি বিচরণ করে না ঐসব লেক ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের পাখি গবেষকদের পরামর্শ ও অনুমতি নেওয়া হয়েছে।”

বক্তব্যের বিরোধিতা করে পাখি গবেষক কামরুল হাসান বলেন, “লেক ইজারার ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি বা পরামর্শও নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে তারাই ঠিক করে দেয় কোন লেকটি ইজারা দেওয়া হবে কোনটি দেওয়া হবে না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই কমিটিতে গত ১৫-২০ বছর যাবত প্রাণীবিদ্যা বিভাগের কাউকে রাখাহয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “ইজারা দেওয়া লেকগুলোতে পাখিদের বিচরণ করা বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছে ইজারা নেওয়া লোকেরা; অতিথি পাখি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু লেক ইজারা নিয়ে থাকলে দেখা যায় মাছের খাবারের কারণে লেকগুলোর পানি অনেক বেশি পরিষ্কার করে ফেলা হয় তখন পাখিদের প্রাকৃতিক খাবার আর থাকে না।”

বহিরাগতসমস্যানিয়ে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীনবলেন, “অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস ক্যাম্পাসে প্রচুর বহিরাগত আসে।ইদানিং আরেক অরাজকতা দেখা যাচ্ছে, পুরো ফ্যামিলি গেট টুগেদার করছে জাহাঙ্গীরনগরে। এগুলো আমরা নিরুৎসাহিত করেছি,বন্ধ করার চেষ্টা করছি। মাঝে মধ্যে নিরাপত্তার স্বার্থে বহিরাগতদের প্রবেশ করতে বাঁধা দেওয়া হলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাদের সহায়তায়তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের একজন বর্তমানে তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন- তিনি বলেন, “আগের সময়ের তুলনায় ক্যাম্পাসে পাখির পরিমাণ অনেক কমেছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে গাড়ির সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে, গাড়ির উচ্চ শব্দে পাখিরা ভয় পায়। ছুটির দিনগুলোতে বহিরাগতদের অনেকে পাখির দিকে ঢিল ছুঁড়ে; যার ফলে এখন পরিবহন চত্বরেরপাশের লেকগুলোতেপাখি বসে না।”

প্রশাসনের এই দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিক্তিক রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ গণমাধ্যমকে বলেন, “পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা যা করা দরকার আমরা তাই করব।”

(ওএস/এসপি/জুন ০২, ২০২৩)