গোপাল নাথ বাবুল


আজ ৫ জুন আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে বিপন্ন পরিবেশ। সমগ্র মানবজাতির এ সঙ্কট থেকে মুক্তি এবং মানুষের বসবাস উপযোগী বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালন করা হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস।’

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে সারাবিশ্ব আজ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। আর এজন্য দায়ী মানুষ। মানুষ তাদের স্বার্থে প্রকৃতিকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছে। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মানুষের উদ্ধত আচরণ, অসচেতনতা এবং সর্বোপরি লোভ এজন্য দায়ী। প্রকৃতি ও পরিবেশের এ ভারসাম্যহীনতা নিয়ে বিশ্বের মানুষ বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। যেমন, চারদিকে নানাবিধ রোগের প্রাদুর্ভাব, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ এসবের জন্য মানুষই দায়ী। মানুষের লোভই মানুষকে পরিবেশের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতে প্রলুব্ধ করছে। নগরায়নের অজুহাতে নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস করছে।

আর এসবের ফলেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যা বর্তমানে পরিবেশবিদদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাময়িক লোভের বশে একশ্রেণির স্বার্থন্বেষী মানুষ ক্রমাগত বনাঞ্চল ধ্বংস করে যেভাবে পৃথিবীর উর্বরাশক্তির ক্ষতি করছে এবং শহরগুলোতে সহজলভ্য অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে যে ক্ষতিসাধন করছে, তা অপূরণীয়। আমাদের বাঁচার তাগিদে এর প্রতিকার আমাদেরই করতে হবে। আজ যারা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যতা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করছেন, তাঁদের কপালে ভাঁজ পড়েছে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ ও ভারসাম্যহীনতায় প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আজ উদ্বিগ্ন।

শিল্প যুগের প্রাক-মুহূর্ত থেকে পৃথিবী খুব দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্য সূচীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ জুন থেকে ১৬ জুন, জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন (ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনফারেন্স অন দি হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট) অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের ‘প্রথম পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এর স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

১৯৭৪ সালে এ বিশেষ দিনটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল সামুদ্রিক দূষণ, মানব জনসংখ্যা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বন্যপ্রাণের মতো পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি স্বার্থে। থিম ছিল ‘একমাত্র পৃথিবী’ (অনলি ওয়ান আর্থ)। বিশ্ব পরিবেশ দিবস জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশ্বজনীন প্লাটফর্ম, যেখানে প্রতিবছর ১৪৩টিরও বেশি দেশ অংশ নেয়। প্রতিবছর পরিবেশ সুরক্ষায় একটি থিম এবং ফোরাম সরবরাহ করা হয়।

এতকিছুর পরেও আমরা চারদিকে দেখতে পাচ্ছি, কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি, আবার কোথাও গ্রীষ্মকালে তুষারপাত কিংবা বর্ষাকালে প্রচন্ড দাবদাহ। প্রকৃতির এ খামখেয়ালিপনার জন্য মানুষের অপরিণামদর্শিতাকেই দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। ব্যাপকহারে শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। গবেষকরা মনে করছেন, উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর পরিমন্ডলের তাপমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
সারাবছর প্রকৃতির সম্পদ উজাড় করে যাদের পেট চলে, তারাও ৫ জুন এলে প্রকৃতি ধ্বংসের কথা, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করে মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেন।

সেদিন পরিবেশের অবনতির কথা নিয়ে তাদের চিন্তা, উদ্বেগ থাকে দেখার মতো। চেহারায় ভেসে উঠে তাদের আকুলতা। মনে হয় যেন, প্রকৃতি ধ্বংসকারীদের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচাতে তাঁরা প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। অনেকটা প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের মতো। সারাবছর যাদের কর্মকান্ড শহীদদের আত্মাকে কষ্ট দেয়, যাদের কর্মকান্ড পাকিস্তানীদের উৎসাহ দেয়, তারাই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে মঞ্চ কাঁপিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিস্তরে বাংলা কায়েমের জন্য বক্তব্য দেন। বলতে বাধা নেই, এ উভয় জায়গাতেই আমাদের নেতাদের উপস্থিতি অবশ্যই থাকে।

গত মার্চ মাসে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শহর-নগরগুলোর উপর করা সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে আমাদের ঢাকা শহর সবচেয়ে দূষিত ৫০টি নগরের মধ্যে একেবারে শীর্ষে রয়েছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২৯৭ নিয়ে রাজধানীর বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ রয়েছে। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের ৫টি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো-বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে রাজধানী ঢাকা।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই সার। এসব কারণগুলোর সমাধানে কোনও উদ্যোগ নিয়েছে কিনা, পরবর্তীতে আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এমনিতে আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম, তার উপর সচেতন মানুষের সংখ্যা তার চেয়েও কম। আমাদের দ্বারা সংঘটিত পরিবেশ দূষণ যে আমাদেরই চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে, তেমন চিন্তা-ভাবনা করার মতো লোকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। আর নগণ্য বলেই আমাদের শহরগুলোকে আমরাই গ্যাস চেম্বারে পরিণত করছি প্রতিনিয়ত, সর্বদাই নিজেদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।

শহরের সবুজ অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে। নতুন কোনো গাছও লাগানো হচ্ছে না। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন এলাকায় নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে, পুরনো রাস্তা বড় করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে কেটে ফেলা বড় বড় গাছগুলো আর ফিরে আসছে না। সরকারি বিভাগগুলো কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না যে, শহরকে সবুজায়ন করার জন্য। এ বিষয়ে দায়িত্বে যারা আছেন তারাসহ এমপি-মন্ত্রীদের ভূমিকাও হতাশাজনক। ৫ জুন ঘটা করে ‘পরিবেশ দিবস’ পালনে এদের জুরি নেই। পরিবেশ নিয়ে চিন্তা, উদ্বেগ তাদের বক্তব্যের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠে। আর যখন বাস্তবে কাজ করার প্রয়োজন পড়ে তখন তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।

বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে আমরা অতীতকে হয়তো ফেরাতে পারব না ঠিকই। কিন্তু আমরা গাছ লাগাতে পারি, আমাদের আশেপাশের শহরকে আরও সবুজ করতে পারি, বাড়ির বাগান পুননির্মাণ করতে পারি, নিজেদের ডায়েট পরিবর্তন করতে পারি এবং নদী ও উপকূল পরিষ্কার রাখতে পারি। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাপলায়েন্সের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এনে পরিবেশবান্ধবের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সোলার পাওয়ার ব্যবহার করতে পারি। পরিবেশবান্ধব যানবাহনের উপর জোর দিতে পারি। যেমন-কয়েক কিমি. পর্যন্ত বাইসাইকেল ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারি। ইকোসিস্টেমকে সুস্থ রাখতে পারি। কীটনাশক ও কেমিক্যালের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করতে পারি। বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেল করতে পারি। নিজ এলাকায় এবং বাড়ির আশেপাশে গাছ রোপণ করে সবুজায়ন ও বনায়ন করতে পারি।

সবকিছুই আমাদের ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে। ইচ্ছাশক্তি থাকলে এসবের মাধ্যমে প্রকৃতির শান্তি বজায় রাখতে পারি। বিশ্ব পরিবেশে সকল জীবকুল একে-অপরের (উদ্ভিদ ও প্রাণি) সঙ্গে নির্ভরশীলভাবে সহবস্থান করতে পারি। প্রাণি ও উদ্ভিদ একে-অপরের সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকা অথবা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এ কথাটি সবাইকে বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে পরিবেশ সুরক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারি। এর ফলে বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে মানবজাতি। এজন্য প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব চিন্তা-চেতনা। মানুষের অবিবেচনা, অসচেতনতা ও সীমাহীন লোভের ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটা মানবসভ্যতাকে এক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের এ প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতা ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার প্রতিক্রিয়ায় ধ্বংসমুখী সভ্যতাকে রক্ষা করতে আমাদের প্রকৃতিচেতনা ও পরিবেশ ভাবনাই হতে পারে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রকৃত দিগদর্শন।

পরিশেষে বলা যায়, পৃথিবী থেকে বনভূমি হারিয়ে যেতে বসেছে। ভূ-উষ্ণায়ন বিপদসীমার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। নিরাপদ জল দুষ্পাপ্য হয়ে উঠেছে। হিমবাহ গলছে প্রতিনিয়ত। সাগর-মহাসাগরের জলস্তর ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফি-বছর সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অসময়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগশোকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। পৃথিবীর হাজার হাজার প্রজাতির মধ্যে মানুষই পৃথিবীর জন্য দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনছে। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মানুষের আত্মশ্লাঘা, তার অহমিকাবোধ পৃথিবীর জীবজগতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এরপরেও যদি মানুষ চেতনাবোধে ফিরে না আসে, তাহলে পৃথিবীর জীবকুলকে চরম বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।