ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


অসহ্য গরম আর অসহনীয় তাপদাহে পুড়ছে সারা দেশ। দেশজুড়ে চলছে বৃষ্টির জন্য হাহাকার। প্রচন্ড গরম-তাপদাহে হাপিয়ে উঠেছে জনজীবন। গরম-তাপদাহের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। দেশের জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্ঠা করছেন আবহাওয়াবিদরা। এই হচ্ছে তো এই হবে, বৃষ্টির স্বস্তি মিলবে শিগগিরই। কিন্তু প্রকৃত খবর কি জানি আমরা? ঠিক কবে এবং কখন ঝরবে এই রহমতের ঝর্ণাধারা? কবে দূরীভূত হবে এই তাপদাহ? জানি না এবং এই না জানাই একজন মুসলমানের ইমানিত্ব। 

সরাসরি স্রষ্টার নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার অন্যতম বৃষ্টি। বৃষ্টি ভূমিকে ঊর্বর ও উৎপাদনশীল করে। বৃষ্টিতে সজীব ও সুশোভিত হয়ে ওঠে গাছপালা ও তৃণলতা। তীব্র খরায়, গ্রীষ্মের দাবদাহে জমিন যখন ফেটে চৌচির হয়ে যায়, চারদিকে প্রকৃতি খাঁ খাঁ করতে থাকে, তখন মহান প্রভুর ঐশী প্রেরণায় এক পশলা বৃষ্টি জগতে সঞ্চার করে নতুন প্রাণের। প্রকৃতি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। মৃতপ্রায় বসুন্ধরা ফিরে পায় তার সজীবতা ও সৌরভ। বৃষ্টি কত বড় নেয়ামত সেটা রাজধানীসহ দেশের কিছু অঞ্চলের মানুষ ভালোভাবে টের পাচ্ছে। বৃষ্টির জন্য চার দিকে হাহাকার। কবে নামবে রহমতের বৃষ্টি সে অপেক্ষা সবার।

অনাবৃষ্টি ও খরার অবস্থায় মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে বৃষ্টির জন্য দোয়া করা উচিত। সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হলে আল্লাহ বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, বালা-মুসিবত অবশ্যই দূর করে দেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘বরং তিনি (আল্লাহ), যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং আকাশ হতে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেন বৃষ্টি, অতঃপর আমি (আল্লাহ) তা দ্বারা মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি, ওগুলোর বৃক্ষাদি উদগত করবার ক্ষমতা তোমাদের (মানুষের) নেই।’ (সুরা নমল)

ইব্রাহিম ইবনু মুনযির (রহ.) ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত , নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইলমে গায়েব (ভবিষ্যতের কথা) -এর চাবি কাঠি পাঁচটি, যা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানে না। তা হল, এক. আগামী দিন কি হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। দুই. মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানে না। তিন. বৃষ্টি কখন আসবে তা আল্লাহ ব্যতিত আর কেউ জানে না। চার. কোনো ব্যাক্তি জানে না তার মৃত্যু কোথায় হবে এবং পাচ. কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে তা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানেনা। (বুখারি, হাদিস নং-৪৩৩৬) আর আল্লাহপাকের ইচ্ছে হলে তিনি তার ধরণীকে মৃত থেকে জীবন্ত করেন এবং বায়ুকে করেন নির্মল। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা বর্ষিত হয় আল্লাহ-তায়ালার রহমতের ধারা হয়ে। বৃষ্টি হলে প্রভুকে স্মরণের শিক্ষাও দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

হজরত মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টি নামতে দেখলে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিয়া’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, উপকারী বৃষ্টি আমাদের ওপর বর্ষণ করুন।

> বৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীতে সজীবতা

সৃষ্টিকুলের জীবনধারণের সব উপকরণ আল্লাহ তাআলা পরিমিতভাবে ও যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন। সবুজাভ প্রকৃতি, শ্যামলি-নিসর্গ ও বনভূমির মাধ্যমে তিনি প্রকৃতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করেছেন।

পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর আমি এর মাধ্যমে সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান, জায়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত ও সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো, যখন সেুগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য করো। নিশ্চয় এগুলোতে ঈমানদারদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯৯)

> গরমে বৃষ্টি হয় আরাম

প্রচ- গরমের দাবদাহে যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মানুষ ও প্রকৃতি, আল্লাহর নির্দেশে পরম শান্তির পরশ নিয়ে হাজির হয় বৃষ্টি। দিনরাত অবিরাম বৃষ্টির ধারা মানব মনকে করে দোলায়িত। এ দেশের পানির সত্তরভাগ চাহিদা পূরণ হয় বৃষ্টির পানির মাধ্যমে। আকাশ থেকে এই তরল ধারা না বইলে পাখি গান গাইতো না। প্রাণ ও প্রকৃতি মরে যেত। বৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতি সতেজ ও নির্মল হয়ে ওঠে। পবিত্র কোরআনে বৃষ্টি, বৃষ্টির কারণ, বৃষ্টির দান, বৃষ্টির শিক্ষা ও বৃষ্টির স্রষ্টার কথা বারবার তুলে ধরা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে তিনি ভূমিকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা কথা শোনে।’ (সূরা নাহল : ৬৫)।

> বাদলা দিনে আল্লাহর রহমত কামনা করা

বৃষ্টি একদিকে যেমন রহমতের, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজাবেরও। এ কারণে রাসুল (সা.) বৃষ্টি দেখলেই আল্লাহর দরবারে উপকারী বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত রাসুল (সা.) যখন বৃষ্টি হতো, তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিআ। (হে আল্লাহ! তুমি এ বৃষ্টিকে প্রবহমান এবং উপকারী করে দাও)।’ (সুনানে নাসাঈ : ১৫২৩)।

> ঝড়ো হাওয়া বইলে আল্লাহকে ভয় করা

কখনো দমকা হাওয়া ও মেঘের ঘনঘটা দেখলে রাসুল (সা.)-এর চেহারায় আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠতো। তিনি আগে-পেছনে উদ্বিগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। এরপর যখন বৃষ্টি হতো, খুশি হয়ে যেতেন। আর তার থেকে এ অস্থিরতা দূর হয়ে যেত। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার আশঙ্কা হয়, আমার উম্মতের ওপর কোনো আজাব এসে না পড়ে।’ তিনি বৃষ্টি দেখলে বলতেন, ‘রহমাতান। (এটা আল্লাহর রহমত।’ (মুসলিম : ১৯৬৯)। হজরত আয়েশা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত, অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) আকাশের প্রান্তে মেঘ উঠতে দেখলে যাবতীয় নফল ইবাদত ছেড়ে দিতেন; এমনকি নামাজে থাকলেও। অতঃপর বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইছি।’ বর্ষা হলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! বরকতপূর্ণ ও সুমিষ্ট পানি দান করুন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১৯৯)।

> বৃষ্টির জন্য দোয়া

উচ্চারণ : আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন, আর রহমানির রহীম, মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফ‘আলু মা-ইউরীদ, আল্লা-হুম্মা আনতাল্লা-হু লা-ইলাহা ইল্লা-আনতাল গনিয়্যু ওয়া নাহনুল ফুকারা-উ, আনযিল আলাইনাল গয়সা ওয়াজ‘আল মা-আনযালতা লানা-ক্যুওয়াতান ওয়া বালাগান ইলা-হীন।

অর্থ : সকল প্রশংসা আল্লাহর। তিনি সারা বিশ্বের পালনকর্তা, মেহেরবান ও ক্ষমাকারী। প্রতিদান দিবসের মালিক। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই। তিনি যা চান তা-ই করেন। হে আল্লাহ, তুমি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তুমি অমুখাপেক্ষী। আর আমরা কাঙাল—তোমার মুখাপেক্ষী। আমাদের ওপর তুমি বৃষ্টি বর্ষণ করো। আর যে জিনিস (বৃষ্টি) তুমি অবতীর্ণ করবে তা আমাদের শক্তির উপায় ও দীর্ঘকালের পাথেয় করো।

উপকার : আয়েশা (রা.) বলেন, লোকজন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অনাবৃষ্টির কষ্টের কথা নিবেদন করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে এই দোয়া করেন। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে বৃষ্টি বর্ষণ হতে শুরু করে। বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের ছোটাছুটি দেখে নবীজি হেসে ফেলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১১৭৩)

> বৃষ্টির জন্য নামাজ

রোদ-বৃষ্টি আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত। কৃষি কাজ ও শস্য ফলানোসহ মানবজীবনের প্রায় অনেক ক্ষেত্রে বৃষ্টি যেমন দরকার, রোদ-গরম ও সূর্যের তাপেরও প্রয়োজনীয়তা তেমন জরুরি। কিন্তু মানুষের আমল ও কর্মের কারণে প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন সময়ে কোনোটার মাত্রা কম-বেশি হয়। কোরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে আলোচনা এসেছে।

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি না হলে, বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় মানুষজন অসুবিধা ও কষ্টে ভোগেন। তখন প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর দরবারে বৃষ্টি কামনা করে দোয়া করা সুন্নত। আরবিতে এটাকে ‘ইসতিসকা’ বা ‘সিক্তকরণের দোয়া’ বলা হয়।

> সালাতুল ইসতিসকা; বৃষ্টি কামনায় নামাজ

আর বৃষ্টি প্রার্থনায় সম্মিলিতভাবে জামাতে দুই রাকাত নামাজও আদায় করা হয়। এটাকে বলা হয় ‘সালাতুল ইসতিসকা’। ইমাম সাহেব কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে রহমতের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। মুসল্লিরাও তখন কায়মনোবাক্যে দোয়া-প্রার্থনা করেন।

বস্তুত পাপমোচনের জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ অন্তরে তওবা-ইস্তেগফার করতে হয়। কেউ অন্যের হক বা মানবাধিকার নষ্ট করলে, তা ফেরত দিয়ে দোয়া করতে হয়। তবেই আল্লাহ তাআলা মানুষের মনোকামনা পূরণ করেন এবং বৃষ্টি দিয়ে নিসর্গ সিক্ত করেন।

পরিশেষে বলতে চাই, ভীষণ এই অনলবর্ষী রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলে স্বস্তির হাওয়া বইবে। রহমতের বারিবর্ষণে প্রশান্ত ও সিক্ত হবে ওষ্ঠাগত প্রাণ। স্নাত ও আর্দ্য-মেদুর হবে বিষিয়ে ওঠা আবহ-প্রকৃতি। জনমানব উদ্বেলিত হবে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে।আর বৃষ্টি মূলত বিধাতার রহমত হয়ে ঝরে পড়ে। মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনাই করি তিনি যেন তার রহমতের বৃষ্টি দ্বারা আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করার তাওফিক দান করুন। কোরআন-হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।