চৌধুরী আবদুল হান্নান


দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে আদর্শ মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা কেবল ধর্মপ্রাণ নারী-পুরুষের নামাজ আদায়ের জন্য নয়, সেখানে ধর্মের নানা বিষয়ে গবেষণা ও প্রচারের জন্য ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও থাকবে। 

তিন তলা বা চার তলা বিশিষ্ট এ সকল আধুনিক মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব হবেন এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে যারা কেবল ইসলাম ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানী নন, প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানী। তাঁরা মসজিদে বয়ানের সময় নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণ, জঙ্গিবাদ, গৃহকর্মীর প্রতি অমানবিক আচরণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আলোচনা করবেন।

বিভিন্ন আলোচনায় বিশেষ করে এ সকল মসজিদ পর্যায়ক্রমে উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের আলেম-ওলামাদের প্রতি এমনই আহবান জানাচ্ছেন।

আরবি ভাষায় মসজিদ অর্থ সিজদার জায়গা, যে কোনো জায়গা নামাজের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত হলে তাই ই মসজিদ। আর এ জন্য ভবন বা গৃহ হওয়া অত্যাবশ্যকীয় শর্ত নয়। এ কারণে কাবা গৃহের চারপাশের ছাদবিহীন উম্মুক্ত প্রাঙ্গনকে মসজিদুল হারাম বা পবিত্র মসজিদ বলা হয়।

ছোট বেলায় গ্রামে চোখে পড়েছে, একজন কৃষক জমি চাষ করতে গিয়ে নামাজের সময় হয়ে গেলে তাঁর লাঙ্গল-গরু দাঁড় করে রেখে ক্ষেতের “আইলে” নিজের গায়ের গামছা বিছিয়ে নিয়ে ফরজ নামাজ আদায় করে নিলেন। বিশিষ্ট আলেমগণ এখানে কি বলবেন?

একজন ব্যস্ত কৃষক তো বসে থাকতে পারেন না, তাঁর নিজের খাদ্য নিজেকেই জোগাড় করতে হয় এবং অন্যদের জন্যও ফসল ফলাতে হয়। ধর্ম শিক্ষা আমাদের শুধু ধার্মিক করে না, অধিক মানবিক ও উদার করে।

কিন্ত আমাদের দেশে বর্তমানে যারা ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের বাণী প্রচার করেন এবং ইসলামের নানা বিষয়ে কথা বলেন, তাঁদের কারও কারও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে, সদুপদেশ দেওয়ার যোগ্যতার অভাব রয়েছে।

অনেক সময় তাঁরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে অপব্যাখ্যা, মনগড়া কথাবার্তা, অবাস্তব ধটনাবলির বর্ণনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলেন। সেখানে ধর্মকে মানব কল্যাণের দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে অন্ধ অলৌকিকতা দিয়ে বেশি প্রকাশ করা হয়।

কোনো ওয়াজ মাহফিলে তাঁদের বয়ানের মূল বিষয় থাকে পরলৌকিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে এবং এ জীবন ক্ষণিকের আর পরকালের জীবন অনন্তকাল ব্যাপী। তাতে মূলত থাকে বেহেস্তের অপার সুখ-আনন্দের ফিরিস্তি, কামনা-বাসনা-ভোগ-বিলাস চরিতার্থ করার অফুরন্ত সুযোগ। দুধ-মধুর নহর কল্পনায় চোখের সামনে ভেসে উঠে। তাদের আকর্ষণীয় বয়ানে মুগ্ধ হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যদি কেউ শহীদ হয়ে এখনই বেহেস্তে যাওয়ার উগ্র বাসনায় আক্রান্ত হয়, তাতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

মাঝে মাঝেই তো দেখা যায়, তথাকথিত জিহাদী ডাকে সাড়া দিয়ে “আমি আর ফিরব না” বাবা-মাকে এমন চিরকুট লিখে উঠতি বয়সের যুবকেরা বান্দরবান-খাগড়াছড়ি পাহাড়ি এলাকায় “ধর্মযুদ্ধের” প্রশিক্ষণ নিতে বাড়ি ছাড়ে।

আজও গ্রামাঞ্চলে মসজিদের ইমামের ফতোয়ায় নারীকে বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপের মত বর্বর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আর কন্যা সন্তানের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা তো হাজার বছর যাবৎ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে ললাট লিখন হয়ে আছে। একাধিক কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার “অপরাধে” নারীকে ঘরছাড়া হতে হয়। অথচ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই, কেবল ১০ মাস গর্ভে ধারণ করা ছাড়া।

রসুল (স:) সেই যুগে ঘোষণা করেছিলেন, “যার প্রথম সন্তান মেয়ে হবে সে জান্নাতি, যার পর পর দু’টিসন্তান মেয়ে সেও জান্নাতি।”

ধর্মীয় এমন অসাধারণ ঘোষণা যুগে যুগে নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

ইসলাম ধর্ম কখনই সাম্প্রদায়িকতা শেখায় না, এর আবেদন মানবতা ও সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য প্রযোজ্য। মহানবী (স:) চাইলে মক্কা বিজয়ের পর সেখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করতে পারতেন কিন্ত তিনি তা না করে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করেন। এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের এক অংশ কীভাবে পথভ্রষ্ট হলো, তা বিস্ময়ের বিষয়।

বাংলাদেশটার জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে। বিশ্বের বৃহত্তম একটি মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি মুসলিম দেশগুলোর চাপছিল কিন্ত তিনি তা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন — হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্মের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে দেশটা স্বাধীন করেছে, তাই এ দেশ কোনো একক ধর্মের মানুষের প্রাধান্য দেওয়ার জন্য নয়, সকল ধর্মের মানুষ এখানে সমান ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বসবাস করবে।

সব ধর্মের মূল বাণী এক, প্রতিটি ধর্মের মানুষ যদি নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ট মনে করে, তাতে কার কী অসুবিধা? আন্তঃধর্মীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে কেন?

সংখ্যার দিক বিবেচনায় জেলা, উপজেলা শহরে অনেক মসজিদ বিদ্যমান রয়েছে, এমনকি গ্রাম গঞ্জেও মসজিদের কোনো ঘাটতি আছে, এমন মনে করা যায় না। কোনো কোনো এলাকায় মসজিদের আধিক্য নজরে পড়ে, মাঝে মাঝে গ্রাম্য দলাদলির দ্বন্দ্বে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণের প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যায়।

ঢাকা শহরকে যেমন মসজিদের শহর বলা হয়, তেমনি মুসলিম প্রধান দেশ বাংলাদেশকেও মসজিদের দেশ বলা যায়। সে বিবেচনায়, ইসলাম ধর্মের মূল বাণী প্রচারে ইমামদের মসজিদ কেন্দ্রীক যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এলাকার মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করে, তাদের কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সেক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য সফল করতে ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানী ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বাছাই করে মানবিক, উদার, দায়িত্বশীল ও মূল্যবোধ সম্পন্ন উপযুক্ত ব্যক্তিকে এ সকল মসজিদে ইমাম, খতিব নিয়োগ দিতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।