বিশেষ প্রতিনিধি, মাদারীপুর : মাদারীপুরের শহীদ সুফিয়া পৌর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। মাঠের জন্য সরকারী জায়গা থাকলেও তা ভরাটের অভাবে বছরজুড়েই থাকে জলাবদ্ধতা। গভীর নলকুপের পানি নেই। ক্লাসরুমও সংকট। টয়লেটের অবস্থাও জরাজীর্ণ, শিক্ষকদের অফিস কক্ষটিও ছোটসহ নানা সমস্যা নিয়ে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা থাকলেও তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি এই চিত্রের। 

তবে অভিভাবকদের দাবী, বিদ্যালয়ের মাঠটিতে জলাবদ্ধতা থাকায় তারা বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের পাঠালেও দুর্ঘটনার ভয়ে খুব চিন্তায় থাকতে হয়। তাই দ্রুত মাঠ ভরাটের দাবী জানিয়েছেন তারা।
এদিকে কর্তৃপক্ষ বলছেন, এ ব্যাপারে কোন বরাদ্দ নেই। তবে তারা ভরাটের জন্য চেষ্টা করছেন।

বিদ্যালয় ও সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৩ সালে সরকারী হয় বিদ্যালয়টি। ২০০৪ সালে বিদ্যালয়ের টিনের ঘর ভেঙ্গে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হয়। বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে অসহায়দের আশ্রয়নের জন্য নিচের তলা পুরো খালি রেখে দ্বিতীয় তলায় ক্লাসরুম নির্মাণ করা হয়। তিনটি শ্রেণী কক্ষ ও শিক্ষকদের জন্য একটি ছোট কক্ষ ও একটি টয়লেট নির্মাণ করা হয়। এতে করে মাত্র তিনটি কক্ষে ক্লাস নিতেও সমস্যায় পড়তে হয় শিক্ষকদের। তাছাড়া ছোট একটি কক্ষে প্রধানশিক্ষকসহ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও সব ধরণের অফিসিয়াল কাজ করতেও তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়।

১৭০ জন শিক্ষার্থী ও ৬ জন শিক্ষকদের খাবার পানি নিয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রায় দুই বছর আগে মাদারীপুর জন স্বাস্থ্য প্রকৌশলী থেকে টিপ টিউবয়েলের ব্যবস্থা করলেও এখন তা পরিপূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় সংলগ্ন বাড়িগুলো থেকে পানি এনে খেতে হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার জন্য টয়লেটটির অবস্থা জরাজীর্ণ। বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। তাছাড়া টয়লেটটি বিদ্যালয় থেকে একটু দুরে হওয়ায় এবং প্রায় সময় জলাবদ্ধতা থাকায় যাতায়াতের পথে বড় বড় ঘাস হয়েছে। ফলে এই পথ দিয়ে সাপ ও পোকামাকরের ভয় থাকায় শিক্ষার্থীরা যেতে ভয় পায়। তাই জরুরিভাবে টয়লেটসহ ওয়াসব্লক দরকার।

আরো দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা। পিছন দিয়ে সিড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতে হয়। পুরো বর্ষা মৌসুমে সিড়ি পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। এছাড়াও বাকি সময় বিদ্যালয় থেকে সামান্য একটু দুরে সরকারী খাল জলাবদ্ধতায় ভরা থাকে। সরকারী এই খালটি বিদ্যালয়ের নামে লিজ নেয়া। তাই এই খালটি ভরাট করলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খেলার জন্য মাঠ পাবে। পাশাপাশি ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে বিদ্যালয়ে আসতে পারবে। অভিভাবকরাও স্বস্তি পাবেন।

সাবা, রেজা, সিমা, শিউলি, আয়ান, আরাফ, আলিফ, তাবসুমসহ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। তারা খেলতে পারে না। বিদ্যালয়ের পাশে পানি থাকায় তারা ভয়ও পায়। তাছাড়া খাবার পানি না থাকায় পাশের বিভিন্ন বাড়িতে পানি খেতে গেলে বিরক্ত হয়।

বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সিমা আক্তারের মা আকলিমা বেগম বলেন, বিদ্যালয়ের পাশেই সব সময় জলাবদ্ধতা থাকে। পানিতে পড়ে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাই মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় লাগে। কি করবো তবুও বিদ্যালয়ে পাঠাতে হচ্ছে। তাই সব শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এটি ভরাট করা প্রয়োজন। তাছাড়া টয়লেটের অবস্থাও খুব খারাপ। ছোট ছোট বাচ্চাদের সমস্যায় পড়তে হয়।

আরেক অভিভাবক লাবনী বেগম বলেন, আমার ভাগ্নি এই বিদ্যালয়ে পড়ে। পড়াশুনার মান ভালো তাই এখানে দিয়েছি। কিন্তু বিদ্যালয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। খেলার মাঠ নেই। সারাবছরই জলাবদ্ধতা থাকে। টয়লেটের অবস্থা খারাপ। খাবার পানিরও ব্যবস্থা নেই। এগুলো সব দ্রুত ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের সুন্দর পরিবেশের ব্যবস্থা করার দাবী জানাই।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরজাহান বেগম বলেন, আমার যে কক্ষে বসে অফিসিয়াল কাজ করি, সেই কক্ষটি ছোট। এক সাথে সবাই মিলে কাজ করতে বা টিফিনের সময় বিশ্রাম নিতেও সমস্যা হয়। পাশাপাশি তিনটি শ্রেণী কক্ষ দিয়েই শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে হয়। তাই শ্রেণী কক্ষও দরকার।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিমা আক্তার বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে অনেকগুলো সমস্যা আছে। বিশেষ করে খেলার মাঠ নেই। বর্ষার সময় একদম সিড়ি পর্যন্ত পানি চলে আসে। শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ খুব জরুরি। সেই সাথে বিদ্যালয়ে শ্রেণী কক্ষের অভাব, টয়লেট ও ওয়াসব্লক জরুরি। বিদ্যালয়ে টিপটিউবয়েলে বসানো হয়েছি। কিন্তু আনুসাঙ্গিক আরো কিছু কাজের জন্য তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমি এখানে ২০১৭ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। তখন বিদ্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ৯৮ জন। সেখানে আমি অনেক চেষ্টা করে, পড়াশুনার মান বাড়িয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাড়িছে ১৭০ জন। তাছাড়া বিদ্যালয়ে যদি খেলার মাঠ ও এই জলাবদ্ধতা না থাকতো, পানি, টয়লেট, ওয়াসব্লকের ব্যবস্থা থাকতো। তাহলে অনেক অভিভাবক এই বিদ্যালয়ে তার সন্তানদের পড়াশুনা করাতে আগ্রহী হতো। এই নানা সমস্যার কারণে অনেক অভিভাবক তার সন্তানদের এখানে ভর্তি করতে চান না। তাই শিক্ষার মান ও সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশের জন্য এইগুলো সমাধান জরুরি। তবে ইতিমধ্যে জেলা পর্যায়ের অনেক ঊর্ধতন কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শণ করে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইউসুফ আলী খান বলেন, বিদ্যালয়টি ভরাটের ব্যাপারে আমি মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলেছি। তাছাড়া এ ব্যাপারে জেলা পরিষদের বরাবরেও একটি আবেদনও করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত এর সমাধান হবে। তাছাড়া পানি ও ওয়াসব্লকের ব্যাপারেও মাদারীপুরের জন স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, নিচু জায়গা, তাই মাটি দিয়ে একট উচু করলে, তারা ব্যবস্থা করে দিবেন।
তিনি আরো বলেন, বিদ্যালয়টির জায়গার একটি বড় অংশ হচ্ছে সরকারী খাস জমি। লিজের জমি হওয়ায় প্রতিবছর নবায়ন করার জন্য সরকারীভাবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা দিতে হয়। সরকারী বিদ্যালয়, এখানে বাড়তি টাকার কোন ব্যবস্থা নেই, তাই নবায়ন করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন হয়, তা দেয়াও সম্ভব হয়না। এটাও বিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় সমস্যা।

মাদারীপুরের প্রাথমিক সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, আমি ইতিমধ্যেই বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি। বিদ্যালয়টিতে নানা সমস্যা আছে। বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাটের জন্য যে টাকার দরকার, তা সরকারীভাবে বরাদ্দ নেই। তবুও আমরা চেষ্টা করছি। শ্রেণী কক্ষ সংকট আছে, যে ব্যাপারেও তালিকা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাইনউদ্দিন বলেন, এ ব্যাপারে সরকারীভাবে কোন বরাদ্দ নেই। তবে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি দরখাস্ত দিলে, সরকারীভাবে টিআর আসলে, তা দিয়ে ভরাটের ব্যাপারে কিছুটা সহযোগিতা করা যেতে পারে।

(এএসএ/এসপি/জুন ১১, ২০২৩)