বিশেষ প্রতিনিধি, মাদারীপুর : মাদারীপুর শহরের ৪ নং শকুনি এলাকার মৃত সেকেন আকনের বড় ছেলে মনির আকনের লাশ দেশে এনে দাফনের দাবী তার পরিবারের। পাশাপাশি তার সারে ৫ বছরের ছোট্ট ছেলে রায়হান এক নজর বাবাকে দেখতে চায়। কিন্তু টাকার অভাবে পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ দেশে আনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার (৯ জুন) রাতে সৌদি আরবে মারা যান মনির আকন। রাস্তায় তার লাশ পড়েছিলো। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে শনিবার সকালে নিহতের পরিবার জানতে পারে মনির আকনের মৃতুর খবর। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। মঙ্গলবার সকালে নিহতের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, সন্তান ও ছোট ভাই-বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। পাড়াপ্রতিবেশিরাও এসে ভীড় করছেন নিহতের বাড়িতে।

সরেজমিনে পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাদারীপুর শহরের ৪ নং শকুনি এলাকার মৃত সেকেন আকনের বড় ছেলে মনির আকন ধার দেনা করে ২০১৭ সালের জুন মাসে সৌদি আরব যান। এরপর তেমন কোন কাজ না পাওয়ায় উল্টো বাংলাদেশ থেকে তার পরিবার প্রায় তার খরচের জন্য টাকা পাঠাতেন। আকামা করার জন্য দেশ থেকে ধার দেনা করে টাকা পাঠালেও ঐ দেশের মালিক তা করে দেননি। আজ-কাল করেও আকামা না দেয়ায় কোন কাজই করতে পারছিলেন না মনির। তাই তিনি দেশেও আসতে পারেননি। এমনকি ছেলে রায়হানের বয়স সারে পাচ বছর হলেও মুখোমুখি বাবা-ছেলের দেখা হয়নি।

আরো জানা যায়, শুক্রবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় মনির আকন তার ছোট বোন রোমানার সাথে শেষ কথা হয়। তখন মনির জানান তার বুকে অনেক ব্যাথা হচ্ছে। সে ওষুধ কিনতে ফার্মেসীতে যাচ্ছেন। এরপর আর কথা হয়নি। পরে সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের সেফা নামকস্থানে যেখানে থাকতেন তার কাছেই রাস্তার উপর তার লাশ পড়ে থাকতে দেখেন ঐ দেশের স্থানীয় লোকজন। তারা ঐ দেশের পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করেন। রাস্তায় পড়ে থাকা ছবি শুক্রবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়। পরে নিহত মনিরের লাশের ছবি দেখে পরিবারের লোকজন সৌদি আরবে খোজ নেন। সেখানে নিহতের সর্ম্পকের এক খালাতো ভাই ইমনের কাছ থেকে মনির আকনের মৃত্যুর ব্যাপারটি নিশ্চিত হন। এরপর থেকেই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতের পরিবারের একটাই দাবী সরকারীভাবে লাশটি যেন বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে দেন।

নিহতের বৃদ্ধা মা জাহানার বেগম কেদে কেদে বলেন, এই শোক আমি কিভাবে সইবো। আল্লাহ আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন। কেন আমার ছেলেকে নিয়ে গেলেন। এত মৃত্যু আমি সইতে পারছিনা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে মনিরের বাবা মারা গেলেন। এরপর ২০২১ সালে কারেন্টে কাজ করতে গিয়ে আমার মেঝ ছেলে ওহিদুজ্জামান আকনও মারা গেলো। এখন আমার বড় ছেলেও মারা গেলেন। ওর অনেক দেনা করে সৌদি আরব গিয়েছিলো। এমনকি সেখানে থেকে আমাদের কোন টাকা পাঠাতে পারেনি। উল্টো আমরাই তার জন্য টাকা পাঠিয়েছি। আকামা করার জন্যও ধার করে টাকা পাঠিয়েছিলাম। সেই আকামাও করে দেয়নি মালিক। ওর হার্টে সমস্যা ছিলো। শ^াসকষ্টও ছিলো। হয়তো অসুস্থ কিনতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় বসেই মারা গেছে। এখন আমাদের একটাই দাবী ওর লাশটি যেন সরকার দেশে এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

নিহতের বোন রোমানা বলেন, ভাইয়ের সাথে আমার শুক্রবার সন্ধ্যায় শেষ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন তার বুকে অনেক ব্যাথা করছে। ঐ দেশে থাকেন বাংলাদেশের পরিচিত একজনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ওষুধ কিনতে যান। সেই টাকাও বাংলাদেশের একজনকে আমাকে দিতে বলেছেন। অনেক দেনা আছে আমাদের। এই বাড়ি ছাড়া আমাদের কোন জমি নেই। যে জমি বিক্রি করে ভাই এর লাশ আনবো। সৌদি আরবে যারা আছেন, তারা জানিয়েছেন লাশ দেশে আনতে ৫ লাখ টাকা লাগবে। এই টাকা আমরা কোথায় পাবো। ভাইকে শেষ দেখা দেখতে চাই।

নিহতের স্ত্রী মিনি বলেন, বিয়ের চার মাস পর মনির সৌদি আরব চলে গেছেন। তখন রায়হান পেটে। দুই মাসের গর্ভবতী আমি। সেই ছেলে জন্ম হলো। দেখতে দেখতে সারে ৫ বছরের বেশি হয়ে গেলো। অথচ আমাদের এমন ভাগ্য যে, বাবা-ছেলের মুখোমুখি দেখা হলো না। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে। তাই আমার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হলেও মনিরের লাশটা যদি দেশে আনা যেতো।

নিহতের ছোট্ট ছেলে রায়হান মারা যাবার বিষয়টি তেমনভাবে না বুঝলেও, এতটুকু বুঝে সে আর তার বাবাকে কোন দিন দেখতে পাবে না। রায়হান বলেন, বাবাকে দেখতে চাই।

নিহতের প্রতিবেশি সৌদি আরবে থাকেন মো. মিজানুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, সৌদি আরবে রাস্তায় মনিরের লাশ পড়ে থাকার ছবি ফেসবুকে দেখি। এরপর খোজ খবর নিয়ে জানতে পারি, ও মারা গেছে। ওর ছেলে এখনও তার বাবাকে দেখেনি, তাই আমরা এখান থেকে লাশ দেশে নেয়ার চেষ্টা করছি। ৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। আমরা ৫০ হাজার দিবো। কিন্তু বাকী আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। তাই সকলে মিলে যদি একটু সহযোগিতা করতেন, তাহলে হয়তো মনিরের লাশ দেশে নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতো।

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাইনউদ্দিন বলেন, কেউ যদি বৈধভাবে বিদেশ যায়, তাহলে অ্যাম্বাসী থেকেই লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। আর যদি অবৈধভাবে যায়, তাহলে অ্যাম্বাসী থেকে এ দেশের অ্যাম্বাসীতে যোগাযোগ করে থাকে। এখন পর্যন্ত এ ধরণের কোন খবর পাইনি বা কেউ আমাদের এখনও এই খবর জানাইনি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(এএসএ/এসপি/জুন ১৩, ২০২৩)