গোপাল নাথ বাবুল


রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ ভূমিকম্পের স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৫ সেকেন্ড। রাজধানী ঢাকা থেকে ২০২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা’র (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ এলাকায়। 

উৎপত্তিস্থলে ভূমিকম্প ছিল ৫ মাত্রার। সীমান্তের ওপারে ভারতেও এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ইউএসজিএস সংস্থাটির মতে, গত ৫ মে রাজধানী ঢাকায় অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটিও ৪.৩ মাত্রার ছিল। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।

পৃথিবীতে যতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে, তার মধ্যে একমাত্র ভূমিকম্পেরই ভবিষ্যত বাণী করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃতির এলোমেলো স্বভাবের কাছে মানুষ যে কত অসহায় ! তা এই ভূমিকম্প থেকে বোঝা যায়। ভূগর্ভ যে কোথায় বেসামাল হয়ে রয়েছে এবং মানুষের চরম সর্বনাশ করে তীব্র বেগে নড়ে উঠবে, তা কারও জানা নেই। তবে পৃথিবীর কোথায় কোথায় ভূমিকম্প হতে পারে তার সম্ভাবনা স্থলের একটা তালিকা ভূ-বিজ্ঞানীরা করেছেন। সে তালিকা অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের প্রতি সবসময় প্রতিরোধ এবং ভূমিকম্প হলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ভূমিবিজ্ঞানীরা। এরপরও হুঁশ নেই মানুষ নামের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণিদের। মানুষের দ্বারা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নানা কর্মকান্ড, অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছে।

বিশেযজ্ঞদের মতে, ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ফল্ট লাইনের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এই অবস্থায় ভূমিকম্প নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। তুরস্ক, সিরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খন্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলে। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। ফল্ট লাইন দিয়ে দুই প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়। তেমনি বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এই রকম মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন রয়েছে। চট্টগ্রাম, ভারতীয় ও ইউরেশিয় টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান সীমানার কাছাকাছি। চট্টগ্রাম দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ফল্ট লাইনের কাছাকাছি অবস্থিত। যার কারণে চট্টগ্রামেই ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। তবে ভূমিকম্পের অবস্থান, গভীরতা এবং মাত্রাসহ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে ঝুঁকির সঠিক মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ, অবস্থানগত কারণে রিখটার স্কেলে ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। এই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে কমপক্ষে চট্টগ্রাম নগরীতে দেড় লক্ষ ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ১৪১টি ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। দেশে শুধু ৫৭টি ভূমিকম্প হয় ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ সালে সকাল ৯টা ২ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। যার স্থায়ীত্বকাল ছিল ৫৩ সেকেন্ড, রিখটার স্কেলে ৫.২ মাত্রার এ ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। সিলেট শহরসহ আশে-পাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ২৯ মে, ২০২১ সালে। ওইদিন টানা ছয় বার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয় উক্ত স্থানগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বে এবং বার্মা প্লেট পশ্চিমে অগ্রসরে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি তৈরি করছে। সেই হিসেবে ৮ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। কারণ মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ভূগর্ভস্থ যে ৩টি ফল্ট লাইন আছে সেখান থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব বেশি নয়। ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসসহ কয়েক লাখ লোকের প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচীর (সিডিএমপি) আওতায় পরিচালিত ডিজিটাল জরিপের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার আবাসিক-ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবনকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে সেসব ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। উল্লেখ্য যে, নগরীর ৭৮ ভাগ ভবন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং সিডিএ’র অনুমোদিত নকশা লঙ্ঘন করে অপরিকল্পিত ও ক্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া কোনও স্থাপনায় ভূমিকম্প প্রতিরোধক কোনও ব্যবস্থাও নেই।

রাজধানী ঢাকার অবস্থাও একই। বড় কোনও ভূমিকম্প সংঘটিত হলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার ওপর একটা সমীক্ষা চালায় সম্প্রতি রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট। তাদের সমীক্ষায় ওঠে এসেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে ঢাকার প্রায় ৪০% অর্থাৎ ৮ লাখেরও বেশি স্থাপনা। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ২.৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বা ২.৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। আবার সিলেটের ডাউকিতে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ধসে পড়তে পারে প্রায় ৪১ হাজার স্থাপনা।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তবে চট্টগ্রাম শহরের ১ লাখ ৮২ হাজার ভবন, ১৬২টি হাসপাতাল ভেঙ্গে যাবে। এতে ১৭ মিলিয়ন টন আবর্জনা তৈরি হবে যা সরাতে ৬ লক্ষ ৮০ হাজার ট্রাকের ট্রিপ প্রয়োজন হবে। শহরের ১ হাজার ৩৩ স্কুলের মধ্যে ৭৩৯ বিল্ডিং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। চট্টগ্রামে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যার মধ্যে ৭৩ হাজার থাকবে স্কুলের শিক্ষার্থী।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ চুয়েটের সাবেক ভিসি এবং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ই্উএসটিসি)-এর উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বাংলাদেশ-মিয়ামার, বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমার-ভারত (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) সীমান্ত এলাকায়। এসব এলাকায় ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে সৃষ্টি হতে পারে। আর তা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার। তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশে ভূমিকম্প হলে আমাদের ঝুঁকি বেড়ে গেলো তেমনটা নয়। ভূমিকম্প যে কোনও সময় হতে পারে। যেহেতু আমরা ফল্ট লাইনের কাছাকাছি, তাই আমাদের বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিক থেকে ভূমিকম্প একটি আকস্মিক ঘটনা, যা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো সময় ঘটতে পারে। পৃথিবীর অন্যতম বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির পর্যবেক্ষণ এমনটাই। অথচ ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত ইত্যাদির মতো ভূমিকম্প ঠিক কোন অঞ্চলে, কোন সময়ে, কী ধরনের ব্যাপ্তিতে ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে আজও আগেভাগে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তাছাড়া ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাকে প্রতিরোধ করার কোনও উপায় এখনও পর্যন্ত মানুষের আয়ত্বে আসেনি।

তবে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পূর্বপ্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। কিন্তু এটা সত্য যে, আমাদের মতো দেশগুলোতে এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় তেমন প্রস্তুতি থাকে না। তার ওপর আধুনিক প্রযুক্তির অদক্ষতার পাশাপাশি রয়েছে পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবলের অভাব। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়। ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৩টি সংস্থা বিদ্যমান থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কারিগরি সক্ষমতা ঘাটতির পাশাপাশি পারস্পারিক সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ সূচকের তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল হিসেবে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার নাম দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে। অর্থাৎ যে কোনও সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এমন অজানা ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত ? উদ্বেগের কথা হলো, এ বিষয়ে জনগণ যেমন সচেতন নয়, সরকারের তরফেও তেমন কোনও প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। তাই জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সীমিত সম্পদে ভূমিকম্প মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সরকার উদ্যোগ নিবে, এমনটাই কাম্য।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।