স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে প্রভাব খাটিয়ে মার্কেট দখল এবং তার মালিক বনে যাওয়া যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে একে দখল হয়ে যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের একেকটা মার্কেট।

জানা যায়, পাঁচ বছর আগে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগর ভবন থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে জাকের সুপার মার্কেট নামে পাঁচতলা বহুতল মার্কেট তৈরি করেছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। কিন্তু বরাদ্দের আগেই সেটা দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মার্কেটের বর্তমান মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিবর্তে সেটা এখন বরাদ্দ দিচ্ছে তারাই। প্রতি দোকান বিক্রি করছে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায়। আবার ১ থেকে ৩ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এভাবে মোট ৭২০টি দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী চক্র লুটে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

ডিএসসিসির হিসাবে দেখা গেছে, মার্কেটটির বেসমেন্ট ও নিচতলায় রয়েছে ১৬৮টি করে দোকান। এগুলোর আয়তন ১০০ থেকে ২০০ বর্গফুটের মধ্যে। দোতলা থেকে পাঁচতলায় রয়েছে ৯৪টি করে দোকান। আয়তন দেড়শ' থেকে আড়াইশ' বর্গফুট। দোকানের ভাড়াটিয়া ও মালিক দাবিদার দোকানিরা জানিয়েছেন, নিচতলা ও বেসমেন্টের দোকানগুলো কিনেছেন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায়। দোতলা ও তিনতলার দোকানগুলোর বেশিরভাগই ভাড়ায় চলছে। তারা ভাড়া নিয়েছেন জাকের মার্কেট দোকান মালিক সমিতির কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রেও অগ্রিমের পরিমাণ ১ থেকে ৩ লাখ টাকা। মাসিক ভাড়া ৭ থেকে ৯ হাজার টাকা। এই টাকার কানাকড়িও ডিএসসিসির রাজস্ব শাখায় জমা হচ্ছে না। দোকান মালিক সমিতিই পুরোটা পাচ্ছে। কিছু অংশ যাচ্ছে ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে।

জাকের সুপার মার্কেট নামের পাঁচতলা ওই বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ শেষ। কিন্তু মামলাজনিত কারণে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মামলা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএসসিসিরই রাজস্ব বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মালিক সমিতি সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে একটি মামলা ঠুকে রেখেছে। সমিতি দাবি করেছে, মার্কেট নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ২৮২ জন নন, এই সংখ্যা ৫৭০ জন। প্রত্যেককেই দোকান বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে মামলা করেছে সমিতি। কিন্তু ডিএসসিসি তা দিতে রাজি নয়।

এদিকে আরো জানা যায়, রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটেরও নকশা পরিবর্তন করে অবৈধভাবে দুই শতাধিক দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। মার্কেটের ফাঁকা স্থান, নামাজের জায়গা, টয়লেট, জেনারেটর রুম এমনকি চলন্ত সিঁড়িটি সরিয়েও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের 'ক' মার্কেটেও শতাধিক অবৈধ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও বিএনপির কিছু লোক এসব অবৈধ দোকান নির্মাণ ও বরাদ্দের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ।

ডিএসসিসি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও এ ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট দোকান মালিক সমিতির শীর্ষ নেতারা আদালতেও গেছেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দোকান নির্মাণের ওপর স্থিতাবস্থা দেওয়া হলেও তা কার্যকর করতে পারেনি ডিএসসিসি ও স্থানীয় প্রশাসন।

জানা গেছে, গত কয়েক মাসে দুই শতাধিক দোকান নির্মাণ করে অন্তত ২০ কোটি টাকায় সেগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তরা সেসব দোকান ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে ভাড়া তুলছেন। অন্যদিকে ডিএসসিসি বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে।

একাধিক সূত্রের বরাত জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে শুরু হয়ে ২০০১ সালে শেষ হয় সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় চলে আসে। ফলে বেশিরভাগ দোকান বরাদ্দ পান তখনকার ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। পরে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হন। ওই মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পেতে মেয়রের সঙ্গে লবিং করেন বিএনপিপন্থি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সাদেক হোসেন খোকার আমলে মার্কেটের বেজমেন্টে আইন লঙ্ঘন করে তিন শতাধিক দোকান অবৈধভাবে নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে সুন্দরবন মার্কেটে ১২শ' ৮টি দোকান তৈরি করা হয়।

এসব দোকান মালিকের বেশিরভাগ বিএনপিপন্থি। মার্কেটের দোকান মালিক সমিতিগুলোর কমিটিও বিএনপিপন্থি লোকজন দিয়ে গঠিত হয়। ২০০৮ সালের পর মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান মালিক বিএনপিপন্থি হওয়ায় মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজন। পরে মার্কেটের মালিক সমিতির কিছু লোককে চাপের মধ্যে রেখে এবং কয়েকজনকে ম্যানেজ করে স্থানীয় যুবলীগের প্রভাবশালী কয়েক নেতা মার্কেটটি নিয়ন্ত্রণে নেন। ততদিনে সাদেক হোসেন খোকা মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি পান। একইভাবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের 'ক' অংশটির বেশিরভাগ খালি জায়গায় অবৈধভাবে দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

(ওএস/এটি/এপ্রিল ২০১৪)