গোপাল নাথ বাবুল


শত সহস্র যুবক-যুবতীর তাজা রক্তের বিনিময়ে এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা। তাঁদের ক’জনেরই বা নাম জানি আমরা! অথচ যাঁদের নাম জানি না, তাঁদের অমর বলিদান ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল অসম্ভব। এ সমস্ত অজানা অখ্যাত বিপ্লবীরা ইতিহাসের পাতায় আজও রয়ে গিয়েছেন উপেক্ষিত। তেমনই একজন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী। যাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখা হয়নি। অথচ দেশের স্বাধীনতার জন্য কীভাবে সর্বসুখ বিসর্জন দিতে পারেন, দেশের স্বার্থে কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারেন, তার সবথেকে বড় উদাহরণ এ মহান বিপ্লবী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী। ১৮৯৪ সালের ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের চাঁদপুরের নিকটবর্তী চালতাবাড়ি গ্রামের মাতুলালয়ে বিপ্লবী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ৫ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। এ মহান বিপ্লবীর প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ছাত্রজীবনে অনুশীলন সমিতির নারায়ণগঞ্জ শাখায় তিনি বিপ্লবী জীবন শুরু করেন। নিষ্ঠা ও কর্ম তৎপরতার জোরে নিজেকে নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯০৮/০৯ সালে বিপ্লবী প্রয়াসকে ব্যাপক করবার উদ্দেশ্যে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং নিবিষ্টচিত্তে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেকে সমর্পণ করেন। ঢাকা শাখার অনুশীলন সমিতির প্রধান সংগঠক পুলিন বিহারী দাসকে গ্রেপ্তার করলে প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী এবং ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সমিতি পুনর্গঠন করেন।

১৯১৩ সালের বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা অভিযুক্ত ৪৪ বাঙালির বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছিল যারা বাংলার ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। এমনিতেই এটি স্বাধীনতার বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ ছিল যা ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের বিদায় নেওয়ার কয়েক দশক আগে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বরিশাল ছিল বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একটি জেলা। সেখানকার ঔপনিবেশিক পুলিশ জানিয়েছে যে, তারা বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে জড়িত কিছু দলিল জব্দ করেছে। এ সমিতির পূর্ববাংলার অংশ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী এবং প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ছিল। জব্দকৃত দলিলগুলোতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পাইকারি গণহত্যায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য জন্মগতভাবে দেশিয় সেনাদের প্ররোচিত করা এবং অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব ছিল। ১৯১৩ সালের জুনে ৪৪ জন বিপ্লবীর বিচার কলকাতায় শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর রাষ্ট্রদ্রোহ প্রচারের জন্য কীভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করেছিলেন তার প্রমাণ আদালতে তুলে ধরেন। সমিতির সভা ও ধর্মীয় সেবার মাধ্যমে ছাত্র এবং অবিবাহিত যুবকদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করেছিল। শুধু বরিশাল জেলায় শত শত অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিল।

১৯১৪ সালে এ মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে ৪৪ জনের মধ্যে ৩২ জনকে বিদ্রোহে কোনো প্রকার সম্পৃক্ততার প্রমাণ না থাকায় অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং বাকি ১২ জনকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১২ জনের মধ্যে প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলীসহ ৫ জনকে ১২ থেকে ১৯ বছরের জন্য আন্দামানে দীপান্তর কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় এবং বাকি ৭ বিপ্লবীকে ২ থেকে ৭ বছরের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কলকাতার দৈনিক ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকা এ বিষয়ে মন্তব্য করে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করায় সম্পাদক মতিলাল ঘোষ ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে একটি কারণ দর্শানোর প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু এ প্রস্তাবটি হাইকোর্টের একটি বিশেষ শাখা খারিজ করে দেয়।

যদিও প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলীকে সাজার মেয়াদের আগেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯২৪ সালে তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। বিপ্লবী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী ঢাকা জেলা কংগেস কমিটি, বেঙ্গল কমিটি এবং অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৯ সালে তিনি ঢাকা শহর থেকে বেঙ্গল বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে রাজশাহীতে বেঙ্গল প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং পুনরায় গ্রেপ্তার করে বিনাবিচারে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয়। ১৯৩৯ সালে পূর্ববঙ্গ মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন কেন্দ্র থেকে এম এল এ নির্বাচিত হন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে জেলে অনশন করে স্বাস্থ্য ভঙ্গ হওয়ায় সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে মুক্তি পান। এরপর নেতাজীর অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৫৭ সালের ৫ জুলাই ভোগে নয় ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এবং পরার্থে নিজেকে নিবেদিত রাখাই যাঁর জীবনের ব্রত, ভারতীয় উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই মহান বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন। জয়তু বিপ্লবী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।