মানিক চন্দ্র দে


বাংলাদেশে এখন ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তির  সংখ্যা বাড়ছে। এই বর্ষা মৌসুমে গত দুই দশক ধরেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধানতম  কারন হলো, এই সময়ে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং সরকারি বিভাগগুলোও এই সময়ে রাস্তায় উন্নয়ন কাজের জোয়ার ঢেলে খোঁড়াখুঁড়ি বাড়িয়ে দেয়। ফলে রাস্তাঘাটে প্রচুর জল জমে যায়।

আমি এখন কানাডাতে বেড়াতে এসেছি। এখানে দেখছি প্রায় দিনই বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি শেষে রাস্তার কোথায়ও কোন জল জমে থাকে না। রাস্তাঘাট এমন শুকনো থাকে যে মনেই হয় না একটু আগে এখানে ধুম বৃষ্টি হয়েছে। এখানের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্হার প্রশংসা না করে সত্যি কোন উপায় নেই।

আমাদের দেশে একসময় প্রচুর খালবিল মাঠঘাট ছিল। এখন সেগুলোকে আমরা কবর দিয়ে ফেলেছি। মানুষ বেড়েছে, ফলে হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। পানি নিষ্কাশনের জন্য মাটির নীচে বড় বড় পাইপ স্হাপন করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

কিছুদিন পরই মাটির নীচে এই পাইপগুলোতে ময়লা জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা নিম্নমানের পাইপগুলো মাটির নীচে ফেটে গিয়ে জল নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কিছুদিন পরপরই রাস্তা বন্ধ করে এসব পাইপ তোলা হচ্ছে এবং সেই জায়গায় আবার নতুন নতুন পাইপ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিছুদিন বন্ধ থাকছে রাস্তায় যান চলাচল। ফলাফল মানুষের দুর্ভোগ দুর্ভোগের জায়গায় থেকে বাড়ছে। কিন্তু সরকারের কাড়ি কাড়ি অর্থের অপচয় হচ্ছে আর জনগনের দুর্ভোগ বাড়ছে। আমাদের পরিকল্পনাবিদদের ও প্রকৌশলীদের ব্যর্থতার কারনে আমরা এই জলাবদ্ধতা দূর করতে পারছি না, ফলে মশার উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে।

আবার আমরা যারা শহরে বাস করছি তারাও নাগরিক হিসাবে আমাদের সঠিক দায়িত্বটুকু পালন করছি না। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিরদ্বিধায় যেখানে সেখানে ফেলছি, বাড়ি নির্মাণের সময় পানি যাতে যেখানে সেখানে জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখছি না। আবার বেজমেন্ট, পার্কিংএ টায়ার টিউব, ময়লা জমা করে রাখছি, যেখানে অনায়াসেই এডিস মশারা বংশবিস্তার করছে আর মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগ ছড়াচ্ছে। হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে রুগীতে।

আমাদের বস্তিগুলোতে বসবাসকারী গরীব মানুষগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্হার প্রতিও সরকারের তেমন কার্যকরী কোন নজর নেই। ফলে সেখানকার অপরিকল্পিত জীবনযাত্রা থেকেও এসব মশার সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে।

মজার বিষয় হলো, মশার প্রধান খাদ্য কিন্তু মানুষের রক্ত না, উদ্ভিদের পাতার রস। তবে গর্ভবতী মশা মানুষের রক্ত খেতে অত্যধিক পছন্দ করে। আমাদের বিরানি পোলাওয়ের মত। কানাডাতে দেখেছি এখানে প্রচুর বন বনানী সবুজ ঘাস ছড়িয়ে আছে। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ত্রিশ ভাগই বনাঞ্চল। লোকসংখ্যা কম, এটাই স্বাভাবিক। এখানের পার্কগুলোতে বেড়াতে গেলে কিন্তু বিশালাকৃতির মশাগুলো সুযোগ বুঝে মানুষকে কামড়াতে ছাড়ে না। আমিও কয়েকবার এসব মশার কামড় খেয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি মশার কামড়জনিত কোন জ্বরে আক্রান্ত হইনি। অথচ বাংলাদেশে আমি মশকবাহী জ্বর ম্যালেরিয়া ( দু'বার) থেকে শুরু করে ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া কোনটার হাত থেকেই রক্ষা পাইনি।

এখানের সরকার নিশ্চয়ই কোন যথোপযুক্ত কৌশল প্রয়োগ করে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া বা কোন প্রকার ভাইরাসবাহী মশাগুলোকে নির্মূল করতে পেরেছে, নিরীহ মশাগুলোর কোনরূপ ক্ষতি না করে। আমরা এসব দেশ থেকেও নিশ্চয়ই এমন অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। টিউলিপ এর চাষ বা লিফট কিনতে আমরা বিদেশে প্রতিনিধিদল পাঠাই, কিন্তু এসব কারনে আমরা বিদেশে কাউকে পাঠাতে শুনি না।

হিউমেন সাইকোলোজিতে বলে আইন অমান্য করা সাধারণ মানুষের জন্মগত স্বভাব। তাই উন্নত দেশগুলোতে মানুষকে আইন পালনের জন্য জরিমানার বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। এই জরিমানা করে আইন পালনে বাধ্য করতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সুন্দর দেশ সিঙ্গাপুর। এজন্য সিঙ্গাপুরকে বলা হয় Country of F& F. অর্থাৎ কান্ট্রি অব ফাইন এন্ড ফাইন। এদেশে একটি দেশলাইয়ের কাঠিও যদি কেউ রাস্তাঘাটে ফেলে তাহলে জরিমানা গুনতে হয়। আর যেখানে সেখানে সিগারেট খেলে তো বড় অংকের জরিমানা দিতে বাধ্য।

উন্নত কোন দেশেই বাড়িঘরের ময়লা বা পরিত্যক্ত জিনিস কেউ রাস্তাঘাটে বা যেখানে সেখানে ফেলতে পারে না। ফেললেই বড় অংকের জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের দেশে কোরবানির সময় বাড়িতে বাড়িতে রাস্তাঘাটে, অলিতেগলিতে গবাদি পশু কোরবানি দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের পক্ষে কোরবানির পর সব ময়লা, বর্জ্য পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। ফলে সেসব বর্জ্য, রক্ত থেকে মশার জন্ম হয়। সৌদিআরবের মত ইসলামিক দেশগুলোতেও এরকম যেখানে সেখানে কোরবানি নিষিদ্ধ। আমাদের সরকার যদি প্রত্যেক পাড়া মহল্লায় একটি সমন্বিত স্লটারিং হাউজ প্রতিষ্ঠা করে দেয় এবং সেখানে যার যার কোরবানির পশু জবাই করতে বাধ্য করা হয় তাহলে কোরবানির সময় পাড়া মহল্লাগুলো ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধ মুক্ত থাকতে পারে।

আসলে নিষ্ঠার সাথে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বৃহত্তর জনকল্যাণে সরকার প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করলে প্রাথমিক পর্যায়ে হয়তো কিছু বাধা আসতে পারে। কিন্তু মানুষ যখন একদিন বুঝবে যে এটাতেই তাদের স্হায়ী জনকল্যাণ নিহীত আছে, তখন এটা নিশ্চয়ই সানন্দেই মেনে নেবে এবং এটা মানার সংস্কৃতিও একদিন মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেমন উন্নত যেকোনও দেশে এসেও আমাদের মত আইন না মানা মানুষগুলোও একসময় সানন্দেই সকল আইন মেনে চলে।

লেখক : কবি, সুলেখক ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।