মোহাম্মদ ইলিয়াছ


অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে  বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যেত, তা হলো মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দেশপ্রেম  ও আপসহীনতা। সমসাময়িক ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর অবশিষ্ট নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থাটা আরো বেহালদশায় পৌঁছেছে। যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বস্তুত দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই অবক্ষয়ের সূচনা করে। অবক্ষয় বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক কিছু স্খলন বা চ্যুতি-বিচ্যুতিকেই বুঝি। যেমন- মাদক; ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, পর্নোগ্রাফি আসক্তি অনিয়ন্ত্রিত-অন্যায্য এবং অপরিণত যৌনাচারসহ কিছু সামাজিক অপরাধকে অবক্ষয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বাস্তবে এর ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি বিস্তৃত। মূলত ক্ষয়প্রাপ্তি, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যকার নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে অবক্ষয়। মূল্যবোধ ও অবক্ষয় পরস্পর বিরোধী; সাংঘর্ষিক। তাই মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল, অবক্ষয় সেখানেই প্রবল। আলো-আঁধারের মধ্যে যেমন সহাবস্থান নেই, ঠিক তেমনিভাবে অবক্ষয় ও মূল্যবোধ একসাথে চলতে পারে না।এই দেশ আমাদের মা, এ দেশ মাটির অস্তিত্ব রক্ষায় লাখো মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন সুতরাং এ দেশের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।

মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রর প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিকশিক্ষা ও মূলবোধের চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রতি উৎসাহ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষাকে অবারিত করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। তবে সব শিক্ষিতই যে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হবে বা অবক্ষয় মুক্ত থাকবে এমনটা আশা করাও ঠিক নয়। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমার বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনি তাদের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার চর্চা কখনো সম্ভব নয়।

এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষাই কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে আপনা-আপনিই নৈতিকতা, মূল্যবোধের ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। তিনি অবক্ষয় মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন।

মূলত আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই এখন অবক্ষয়ের জয়-জয়কার চলছে। নৈতিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের ব্যাপকতার প্রতিই অঙুলি নির্দেশ করে। এখন সব ক্ষেত্রেই অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়েই এর পরিসর বিস্তৃতি। সম্প্রতি পরকীয়া, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, সন্ত্রাস, বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতি অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই এ ধরনের অপরাধ এখন ক্রমবর্ধমান। এ জন্য দেশে গণমুখী ও সুস্থধারার রাজনীতির বিচ্যুতিকেই অনেকেই দায়ী করেন।

রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহৎ। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই প্রবাদ আছে,।' সম্মান করলে সম্মান পাওয়া যায় '। আমাদের প্রেক্ষাপটও বোধহয় তা থেকে আলাদা নয়।

অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালী অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করেছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বাস্তবতা সে ধারণার অনুকূলে কথা বলে না।

প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, লালন ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ বলে বিবেচিত।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।