চৌধুরী আব্দুল হান্নান


পরিচালক শব্দটি সমীহ জাগানিয়া, তা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হোক না কেন। আর ব্যাংকের পরিচালক তো অনেক সম্মানের পদবি আর আর্থিক খাতে তাঁর অসীম ক্ষমতা। বেসরকারী ব্যাংকে তাঁরা কেবল পরিচালকই নন, হাস্যকরভাবে ব্যাংকের মালিক হিসেবেও পরিচিত। 

তাঁরা পরিচালক, তা মানলাম কিন্ত ব্যাংকের মালিক হন কীভাবে ? তবে তাঁদের আচরণ বা কর্মকান্ড দেখলে মনে হবে তাঁরা মালিকই বটে। একজন মালিক তাঁর মালিকানায় ইচ্ছে মতো সব কিছু করতে পারেন, যেমন পারেন একজন রাজা তার রাজত্বে। রাজার কোনো ভুল নেই, ব্যাংক পরিচালকেরও; কারণ তাঁরা রাজার মতোই। তা না হলে ব্যাংকে রক্ষিত আমানতকারীদের জমা অর্থ এভাবে নিজেরা লুটপাট করতে পারতেন না। কোনো দিন এসব অপকর্মের জবাব দিতে হবে, তাঁদের এমন ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।

এবার আসুন, আমরা দেশের পত্র-পত্রিকার আয়নায় মাত্র কয়েকজন ব্যাংক পরিচালকের চরিত্র দেখি।

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নকল পরিদর্শন রিপোর্ট ব্যবহার করে ভুয়া কোম্পানির নামে ২০ কোটি বের করে নেওয়ার জালিয়াতি ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টে। এ দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলা চলমান থাকা অবস্হায় গত বছরের নভেম্বরে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।

ওই একই ব্যাংকের আর এক পরিচালকের দুই শতাধিক ভুয়া এফডিআর থাকার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেনামি এ সব এফডিআর এর আসল মালিক ব্যাংকটির পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, যা গত জানুয়ারীতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর এক তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন এক পরিচালক ও সংসদ সদস্য মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে কুয়েতে আটক হয়েছিলেন এবং তাকে কারাগারেও পাঠানোহয়েছিল।

এন আর বি সি ব্যাংকের এক সাবেক চেয়ারম্যানের কর্মকান্ড আরও চমকপ্রদ, তিনি ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মিথ্যা তথ্য দেয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদ পড়েছিলেন।

নজীর বিহীন ঋণ জালিয়াতি করেছেন পূবালী ব্যাংকের এক চেয়ারম্যান ও এক পরিচালক, তারা নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণ দুই যুগ পার হওয়ার পরও পরিশোধ করেননি; খাতা কলমে তাদেরকেখেলাপিও দেখানো হয়নি। ছলচাতুরীর মাধ্যমে এই ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে ব্যাংক পরিচালক হিসেবে বহাল ছিলেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ রিপোর্টে এ সব চান্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে এবং ব্যবস্হাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্হা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়ার আগেই প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান ব্যাংকটির পরিচালক বানানোর সুযোগ দেওয়ার নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ নেওয়া শুরু করেছিলেন। ওই টাকা তিনি ব্যাংকের হিসাবে জমা দেননি, ফেরতও দেননি। সেই টাকা দিয়ে তিনি গুলশানে ফ্লাট ওদামি গাড়ি ক্রয় করেন। এক সময়ের আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহসভাপতি তিনি দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন।

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান তার কুকীর্তির জন্য দেশব্যাপী এমন পরিচিতি পেয়েছেন যে তার নাম সকলের মুখে মুখে। তিনি ব্যাংকটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ২ হাজার কোটি টাকার অধিক আত্মসাৎ করে দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, ৮ বছর পর অবশেষে তিনি দুদকের ৫৮ মামলা মাথায় নিয়ে তিনি এখন নিরুদ্দেশ। রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটিতে তার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে ঋণের নামে ৪ হাজার কোটি টাকার অধিক লোপাট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুরবস্হা প্রকট, সবচেয়ে নাজুক অবস্হায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। অভিযোগ আছে বিগত এক দশকে শুধু চেয়ারম্যানের বিশেষ দৃষ্টির কারণেই জনতা ব্যাংকের মন্দ ঋণ সবচেয়ে বেশি স্ফিত হয়েছে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পরিচালনা পর্ষদের মাত্র কয়েকজন পরিচালকের চান্চল্যকর এবং লজ্জাজনক কর্মকান্ডের এসব আংশিক চিত্র, পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসা এবং এক পর্যায়ে পত্রিকায় প্রকাশিত।

ব্যাংক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে সরাসরি অর্থ নিয়ে কারবার এবং সে কারণে এখানে সকলকেই সততার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। যাদের চারিত্রিক শুদ্ধতার অভাব এবং যারা অর্থের লোভ সংবরণ করতে পারেন না, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে তারা বিপজ্জনক।

এ জাতীয় লোকজন পরিচালনা পর্ষদে রেখে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা কেবল হাস্যকর নয়, মূর্খতাও।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন— “ব্যাংক পর্ষদ কোনো খেলার জায়গা নয়, যে কাউকেই আর পরিচালক বানানো হবে না।”

অর্থমন্ত্রীর এমন ভাবনায় আমরা আর একবার আশার আলো দেখেছিলাম এই ভেবে যে পতোন্মুখ ব্যাংক ব্যবস্হা এবার ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কিন্ত তা হয়নি।বরং সম্প্রতি আইন সংশোধন করে ব্যাংক পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করে তাদের দোর্দন্ড ক্ষমতাকে আরও বেপরোয়া ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হলো।

আর কতদিন রাঘব বোয়ালেরা ব্যাংকিং খাতকে টাকা বানানোর উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে থাকবেন ?

আপিল বিভাগের এক মামলার শুনানিতে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন - “কিছু লোক লেখাপড়া করে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য; এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুট করার জন্য।”

অর্থলোভী, অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা এভাবে ব্যাংক পরিচালিত হতে থাকলে পুরো ব্যাংক ব্যবস্হার ক্রমাবনতি প্রতিরোধ করা যাবে না। পেশাগত অভিজ্ঞতা বিবেচনা না করে কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় আর মুখ চিনে চিনে ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলে অবস্হার উন্নতি হতে পারে না।

অবশেষে গত বছর অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ঘোষিত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা কিছুটা হলেও আবার আশা জাগায়। সে নীতিমালায় অন্যান্য শর্তের মধ্যে পরিচালকদের এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য থাকার কথা বলা হয়েছে। এ পর্ষদকে অধিক কার্যকর করতে দক্ষ ও স্বচ্ছভাবমূর্তি সম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারদের মধ্য থেকে দু-একজন করে পরিচালক নেওয়ার প্রস্তাব করা।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।