চাঁদপুর প্রতিনিধি : গ্রাহকদের আমানতকৃত কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রয়েছেন স্বদেশ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড চাঁদপুরের কর্মকর্তারা।

কুরবানির ঈদের আগে বন্ধ করা অফিস এখনও তারা খোলেননি। কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতিকে ফোন দিলেও রিসিভ করেন না। সমিতির গ্রাহকরা তাদের জমা টাকার জন্য এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ।পাওনাদারদের ফোন দেখলেই মালিক ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিচ্ছেন।

চাঁদপুর শহরের কালীবাড়ি মোড়ে ফজলু ম্যানশনের ৩য় তলায় বেশ ক’ বছর ধরে হাজীগঞ্জ উপজেলার রামপুর বাজারের জনৈক প্রধানীয়া চাঁদপুর শহরে স্বদেশ মাল্টিপারপাসের একটি শাখা অফিস খোলেন। প্রতিষ্ঠানটির মূল অফিস হাজীগঞ্জ বাজারে। চাঁদপুর শাখার রেজিঃ নং-৬৪৩। ‘কর্মসংস্থান, বেকারত্ব নিরসন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায়’ এ শ্লোগান নিয়েই তারা উক্ত শাখা খোলেন। প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকদের মাঝে লোন দেয়ার পাশাপাশি আমানত জমা নেয়া হতো।

আমানতকারীদের প্রতি ১ লাখ টাকার বিনিময়ে মাসে ১৮শ’ টাকা করে দেয়া হতো। চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন সুধীজন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রায় কোটি টাকা তাদের আওতায় জমা রাখেন। তাদের মধ্যে শহরের ট্রাকরোড এলাকার মনির হোসেনের ১৬ লাখ, হারুন আল রশীদের ১০ লাখ, নাট্য কর্মী হানিফের ১ লাখ টাকাসহ অনেকেরই আমানত বাবদ বিপুল টাকা জমা রয়েছে। কিন্তু ঈদের পর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তাকেই অফিসে আসতে দেখা যায়নি। অফিস তালা মারা। অফিসে কর্মরত চাঁদপুর ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ব্রজ গোপাল মণ্ডল এবং সিনিয়র অফিসার সোহেল আহম্মদ শহরের ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে উধাও হয়েছেন। এ দু জনের বাড়িই পটুয়াখালী জেলায়।

এ মাল্টিপারপাস থেকে পাওনাদার মুনির হোসেন জানান, আমার জানা মতে, প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক সোহাগ প্রধানীয়াসহ অন্য কর্মকর্তারা হাজীগঞ্জে রয়েছেন। আমি আমার টাকার জন্যে তাদেরকে বেশ ক’বার ফোন দিয়েছি। তারা আমার ফোন রিসিভ করছেন না। আমি সমবায় অফিসে তাদের বিষয়টি জানিয়েছি।


চাঁদপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা শেখ কামাল হোসেনের সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি জানান, আমি এ জেলায় নতুন এসেছি। ওদের কার্যক্রম চাঁদপুর চলে এটা আমার জানা নেই। ওদের চাঁদপুরে রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা তাও আমি জানি না। আমি বিষয়টি শুনেছি, অবশ্যই দেখবো।

ফজলু ম্যানশনের নিচতলায় ক’জন দোকানদার জানান, ঈদের পর থেকে ৩ তলার সমিতির অফিসটি খোলা হয়নি। প্রতিদিনই মানুষ তাদেরকে খুঁজতে আসছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পাওনাদারদের কাছ থেকে জানা যায়, মার্কেটে আমানতকারীদের কাছে তাদের দেনা ১ কোটি ৭৬ লাখ, আর তারা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে পাবে ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
সমিতির সভাপতি জামাল হোসেন প্রধানিয়া সমিতির সমস্যা শুরুর জন্য দায়ী। কথিত আছে তিনি নিজেই প্রায় ১৬ কোটি টাকার হিসেব দিতে পারেননি বলে এদের ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। এর পরেই জামাল হোসেনসহ আরো ক’জন মালিক এবং কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। জামাল হোসেনের আপন চাচাতো ভাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহাগ প্রধানিয়া প্রথমদিকে পালিয়ে থাকলেও এখন কিছুটা জনসম্মুখে দেখা যায়।

এই দু কর্মকর্তার আত্মীয়রা এখানে চাকুরি করেছে বলে প্রতি মাসে মোটা বেতন উঠিয়ে নিতেন। ‘কাগুজে’ আত্মীয়রা এ প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছেন দেখালেও প্রকৃত পক্ষে ঐ আত্মীয়রা কখনো এ প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেননি।

অপরদিকে পাওনাদারেরা কোটি কোটি টাকার হিসেব দিতে না পেরে এবং ডিপোজিট হোল্ডাররা যখন একের পর এক প্রধান কার্যালয়ে ডিপোজিট উঠিয়ে নিতে আসতে শুরু করে তখন এরা প্রধান কার্যালয়টি নিজেরাই বন্ধ করে গা ঢাকা দেন।

এর পরেই এদের নামে বিভিন্ন থানায় যেমন হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর সদর ও কচুয়া থানায় মামলা হতে শুরু করে। এর মধ্যে সবচে বেশি মামলা হাজীগঞ্জ থানায় হয়েছে। আর জামাল কিংবা সোহাগকে আটক করার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজেছে। পরে ঐ মামলাগুলোর বেশ বড় একটা অংশ গ্রাহকের সাথে আপোষ করে নিয়েছেন সমিতির নীতি নির্ধারকরা। তবে বর্তমানে এই প্রধান কার্যালয়ে ২/৩জন কর্মকর্তা দিনের কিছুটা সময় বসেন। বাকি চেয়ারগুলো দীর্ঘদিন ধরে অলসভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে হাজীগঞ্জের ভাজনাখাল এলাকায় মৎস্য চাষ প্রকল্প, গরু মোটাতাজা করণ প্রকল্প, বায়োগ্যাস প্লান্ট, হাজীগঞ্জ মধ্য বাজারে সমিতির প্রধান কার্যালয়ের নিচতলা, উপজেলার রামপুর উত্তর বাজারে ও চাঁদপুর শহরের শপথ চত্বরে বিশাল পরিসরে স্বদেশ বুটিক্স নামের ব্যবসাগুলো এখন শুধুই অতীত।
তবে স্বদেশ সমিতিসহ অন্য সমিতিগুলো পথে বসার জন্য অধিকাংশ গ্রাহক জেলা ও উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাগণকে দায়ী করছে। আর এ সকল গ্রাহকের সোজা যুক্তি হলো : সমিতিগুলোতে একদিন হিসেবের গরমিল শুরু হয়নি। গরমিল শুরু হয় কয়েক বছর ধরে কিংবা ১ বছর ধরে। তাহলে ঐ একটি বছরে যে অডিট সমিতিতে হয়েছে সেই ক্ষেত্রে জেলা কিংবা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাগণ কী দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাজীগঞ্জের একটি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইাটির এক কর্মকর্তা বলেন, স্বদেশ কেন মার খাবে এটা আমার বোধগম্য নয়। এদের বিশাল ক্যাশ ছিলো। আরেক প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, হয় এরা লোভে পড়ে গ্রাহকের টাকা মেরে দিয়েছে নচেৎ সরকারি নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত মুনাফা নিয়ে গ্রাহক ধরে রাখতে গিয়ে পথে বসেছে।

স্বদেশ মাল্টিপারপাসের গ্রাহকের করা মামলাগুলো বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কথা হয় হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ আলমের সাথে। তিনি বলেন, এদের নামে অনেকগুলো অভিযোগ জমা আছে। আমরা সময়মতো এগুলো নিয়ে কাজ করবো।

(এএসবি/এসসি/অক্টোবর৩০,২০১৪)