চৌধুরী আবদুল হান্নান


‘৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বিরোধীতা করেছিল, পাকিস্তানি শত্রু বাহিনীর নির্মম কর্মকান্ডের সহযোগীছিল, স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পর তাদের বিচার করা সম্ভব হবে তা অনেকেরই ভাবনায় আসেনি।

পরাজয়ের অপমান মানুষ কখনও ভুলে না, যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তারা ভুলে যায়নি, মনে রেখেছেপ্রতিশোধ নেওয়ার তীব্র ক্ষোভ আর হিংস্ত্রতা বুকে নিয়ে।

অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা যুদ্ধে জয়ী হয়ে বিজয়ের মহানন্দে আত্মহারা। এক পর্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়লো; ওই সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিটি বক্তিতায় প্রাকাশ্যে দুর্নীতিবাজদের প্রতিহুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।

একদিকে স্বাধীনতা পেয়ে বিজয়ী দল আনন্দ-উল্লাসে অন্ধ , অন্যদিকে যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর রাজাকার, আলবদর, আলসামস জোটবদ্ধ নেতৃত্ব গোপনে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে আর তাদের বিদেশি শক্তির ইন্ধন তো রয়েছেই। ভিতরে ভিতরে তাদের রাজনৈতিকভাবে এবং আর্থিকভাবে কত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সেদিকে নজর দেওয়ার সময় হয়নি।

ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ এর আগস্ট-ট্রাজেডি। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি, পরাজিত শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বন্দি দীর্ঘ ২১ বছর। ’৭৫ পরবর্তী প্রজন্মের সামনে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিলনা, অফিস আদালত থেকে জাতির পিতা অপসারিত হন কিন্ত ওরা জানে না মহামানবের কীর্তি গাঁথা মুছে ফেলা যায় না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দন্ডদান ছিল একটি অসম্ভব কাজ। দেশে বিদেশে বিএনপি জামায়াতের নেতৃত্বে এই বিচারের প্রচন্ড বিরোধীতা ছিল। এই বিচার ভন্ডুল করার জন্য দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল কিন্ত হাসিনা সরকার সাহসের সঙ্গে এই বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেশের বৃহত্তর জনমনে চরম ঘৃণা বিদ্যমান ছিল। মা বোনদের ধরে নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে পৌছে দিয়েছে এ দেশেরই কিছু কুলঙ্গার, তাদের সবাই ফিরে আসেনি, কেউ এসেছে সব হারিয়ে। কোন বাড়িতে উঠতি বয়সের মেয়ে আছে তার খোঁজ দিয়েছে তারা। তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে , ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যা সংঘটিত করেছে।

যারা এমন মর্মন্তুদ ঘটনার শিকার হয়েছেন, কেবল তারাই বুঝেন এ দুর্বিষহ মনোকষ্ট হৃদয়ে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে।অপরাধীদের যে শাস্তিই হোক, ভুক্তভোগীদের সম্মান, জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা গেলে কিছুটা হলেও তারা স্বস্তি পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে কাজটিই করেছেন।

মানুষের হৃদয়ে নাম লিখতে, ইতিহাস গড়তে অনেক কাজ করার দরকার হয় না, এমন দু-একটি কাজই যথেষ্ট।

বিচার প্রক্রিয়া বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতাও কম ছিল না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠনের প্রারম্ভেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাও বিচার প্রক্রিয়ার নেতিবাচক সমালোচনা করে। এমন কি, শুরু থেকেই জাতিসংঘ এই বিচারের কঠোর সমালোচনা করে আসছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাধাবিঘ্ন সত্বেও হাসিনা সরকার গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সারাবাংলার মানুষের অনন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভূতপূর্ব এক গণসমাবেশের সূচনা হয় যা “গণজাগরণ মঞ্চ” নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভের বিস্ফোরণ হতে থাকে এবং গগন বিদারী স্লোগানে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। বিচারের দাবিতে আজ লক্ষ মানুষ মাঠে নেমে এসেছে, একটি মাত্র ইস্যু নিয়ে এমন জাগরণ কেউ দেখেনি আগে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নাম আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে “গণ আদালত” বসিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামের আমির গোলাম আযমের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করেছিলেন। আজকে যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে তার অন্যতম কারিগর জাহানারা ইমাম। তাঁর ছড়িয়ে দেওয়া সেই প্রজ্জ্বলিত আলোক শিখা সতত প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করে আসছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিস্ময়কর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সকল সুযোগ দিয়ে ট্রাইবুনালে নিয়োগপ্রাপ্ত বিজ্ঞ বিচারকদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করছেন। এককালে যা অভাবিত ছিল তা আজ বাস্তব, ন্যায্যতার বিজয় ঘটেছে। দেশের মানুষ যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ট্রাইবুনাল গঠনের দাবি করেছিল তার ফলাফল তারা পেয়েছে।

শেখ হাসিনা এবং কেবল শেখ হাসিনাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন। সীমাহীন দুর্নীতিতে আক্রান্ত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, এমনকি শত্রুরাও শেখ হাসিনাকে দুরনীতিপরায়ণ বলে সমালোচনা করেনি।

তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে দেশ, ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাধা করার গুরুদায়িত্ব এখন তাঁর ওপর।

অভিবাদন জানাই বিজয়ী বাঙালির প্রতীক জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।