গোপাল নাথ বাবুল


চন্দ্র বিজয়ের পর এবার সূর্য জয়ের লক্ষ্যে মহাকাশযান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে ভারত। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২ সেপ্টেম্বর ১১টা ৫০ মিনিটে ইসরোর মহাকাশযান আদিত্য এল-১ শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে পিএসএলভি সি-৫৭ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হবে। প্রায় ১৫০০ কেজির রকেটটি ২৪৪ কেজির ৭টি পেলোড মাথায় নিয়ে যাত্রা করবে এ মহাকাশযানটি।

এ প্রথম কোনও ভারতীয় মহাকাশযান সূর্যের ওপর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে। গত ২৩ আগস্ট চন্দ্রযান-৩ চাঁদের বিপজ্জনক স্থান দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করার পরই সূর্য অভিযানের ঘোষণা দিয়েছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’। এর আগে এ অভিযান ২০২০ সালে করার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে সেবার তা স্থগিত করা হয়েছিল। তাই এ অভিযান নিয়েও সমান আগ্রহ বৈজ্ঞানিক মহলে। সূর্য নিয়ে নানা গবেষণা চালাবে এ মহাকাশযান।
আদিত্য (সূর্য) নামটি নেওয়া হয়েছে ঋগ্বেদ থেকে। অদিতি সনাতন ধর্মের একজন বৈদিক দেবী। অদিতি’র অর্থ হলো অসীম বা সীমাহীন। ঋগ্বেদে অদিতিকে অনন্ত আকাশ, চেতনা, অতীত, ভবিষ্যত এবং উর্বরতার দেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি দক্ষরাজের কন্যা এবং মহর্ষি কশ্যপের স্ত্রী। এর গর্ভে ১২ জন দেবতার জন্ম হয়েছিল, যাঁরা দ্বাদশ আদিত্য নামে পরিচিত। আর এল-১ একটি বৈজ্ঞানিক নাম।

যেভাবে চাঁদে বিক্রম সরাসরি ল্যান্ডিং করেছিল, সূর্যতে সেটা সম্ভব নয়। তাই এটা সূর্যের কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে। মূলত এ মিশনের মাধ্যমে সূর্যকে একটু কাছে গিয়ে বিশ্লেষণ করবেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা এবং এখান থেকে পাওয়া তথ্য ইসরোতে পাঠানো হবে। এরপর ইসরোর বিজ্ঞানীরা তা বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন তথ্য জানার চেষ্টা করবেন। এ কারণেই আদিত্য এল-১ কে লঞ্চ করতে ইসরো সবচেয়ে শক্তিশালী পিএসএলভি সি-৫৭ রকেটটি ব্যবহার করবে। যেভাবে চন্দ্রযান লঞ্চ করার পর পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে নিজের ল্যান্ডিংয়ের মোমেন্টটাইম ঠিক করেছিল, ঠিক সেভাবে সৌরযানটিও একইভাবে লঞ্চ করার পর বেশকিছুদিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে নিজের স্প্রীড বাড়িয়ে নেবে। এরপর যখন একটা পর্যাপ্ত স্প্রীড পেয়ে যাবে তখন এটা সূর্যের দিকে লঞ্চ করবে। সূর্যের এল-১ থেকে শুরু করে এল-৫ পর্যন্ত ৫টি পয়েন্ট রয়েছে। আর এ ৫টা পয়েন্টের মধ্যে এল-১ নামক পয়েন্টে আদিত্যকে পাঠানো হবে। এ কক্ষপথের বৈজ্ঞানিক নাম ‘হ্যালো অরবিট’, যা অনেকটা অর্ধবৃত্তীয় কক্ষপথ।

আমরা জানি, প্রত্যেক গ্রহ, উপগ্রহ বা নক্ষত্রের একটা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি রয়েছে, যার দরুণ আশেপাশের বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। একইভাবে সূর্য ও পৃথিবী পরস্পর পরস্পরকে নিজের দিকে টানছে। তবে এ দুই গ্রহ ও নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একটা পয়েন্টে গিয়ে শূন্য হয়ে যায়। যেখানে সূর্য এবং পৃথিবী কারো পক্ষে এ টান কাজ করে না। ঠিক সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানের এ পয়েন্টটাকেই বলা হয় এল-১। সবচেয়ে সুবিধা হলো এ পয়েন্টে আদিত্য এল-১ এর কোনও আলাদা শক্তির প্রয়োজন হবে না এবং কোনও প্রকার চাপও স্পর্শ করবে না। জ্বালানি খরচও খুবই কম। সুতরাং এ পয়েন্টে আদিত্য ব্যালেন্স হয়ে যাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবে এ সৌরযানটি সবসময় সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে নিজের মিশন চালিয়ে যেতে পারবে। আর যেভাবে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরবে ঠিক সেভাবেই আদিত্যযানটিও পৃথিবীর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরতে থাকবে। পৃথিবী থেকে এল-১ পয়েন্টের দূরত্ব প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। অর্থাৎ চন্দ্রযান থেকে প্রায় ৪ গুণ বেশি ভ্রমণ করতে হবে এ সৌরযানকে। সুতরাং এল-১ পয়েন্টে পৌঁছাতে আদিত্যযানের প্রায় ১০৯ দিনেরও বেশি সময় লাগতে পারে এবং আগামী ৫ বছর পর্যন্ত এ যান সূর্যকে বাধাহীনভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এ মিশন ভারতের স্পেস প্রোগ্রামকে একটা নতুন সফলতা এনে দেবে।

ইসরোর বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যানুসারে মিশনটির মূল কাজ হবে-সূর্যের ওপর বায়ুমন্ডলীয় গতিবিধি অধ্যয়ন করা। সূর্যের বিকিরণের প্রভাব অন্যান্য গ্রহে বিশেষ করে পৃথিবীতে কী হতে পারে তার জন্য সূর্য থেকে বিকিরণের কণার (সৌরঝড়ের ফলে বিচ্ছুরিত কণাসমূহ) ওপর গবেষণা, এর ছবি ও তাপমাত্রার অসম বৃদ্ধির কারণ কী ? তার বিশ্লেষণ করা। ক্রোমোস্ফিয়ারিক ও করোনাল হিটিং আংশিকভাবে অয়নিত প্লাজমার পদার্থবিদ্যা, করোনাল ভর নির্গমণের সূচনা এবং অগ্নিশিখা অধ্যয়ন করার কাজও করবে এবং প্লাজমা পরিবেশও পর্যবেক্ষণ করবে মহাকাশযানটি। বিভিন্ন ওয়েভব্যান্ডে সূর্যের বাহ্যিক স্তরগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য মহাকাশযানটিতে মোট ৭টি পেলোড থাকবে। এ ৭টি পেলোডের মধ্যে বিশেষ পেলোডটি হলো ‘করোনোগ্রাফার’। এটি একটি বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপিক ক্যামেরা। এটা সৌরযানের বাইরে ডিস্ক আকৃতি ফিক্সড করা থাকে। ওটার কাজ অবিরাম সূর্যের ছবি তোলা, তাপ শোষণ করা ও এটার আরেকটি কাজ-যানের সেন্সর সক্রিয় রাখা।

সূর্য কীভাবে তাপ উৎপন্ন করে সে তথ্য গবেষণার পাশাপাশি সূর্যের চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে নিরীক্ষা চালাবে এবং সূর্যের স্তর ‘সোলার করোনা’ নিয়েই গবেষণা করবে এল-১। সূর্যের বাইরের দিকের তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি কেলভিন। নিম্নস্তরের তাপমাত্রা সেই তুলনায় কম, প্রায় ৬ হাজার কেলভিন। সূর্যের পৃষ্ঠদেশ, করোনার তাপমাত্রার ফারাক, করোনা থেকে ছিটকে আসা আগুনের ফুলকি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কীভাবে প্রভাব ফেলে তা আদিত্য এল-১ খুঁজে বের করবে। সূর্যের করোনার তাপমাত্রা গড়ে ১০ লক্ষ বা তার কিছু বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা কখনও কমে আবার কখনও বাড়ে কেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে আদিত্য এল-১।

মহাকাশ বিজ্ঞানী সন্দীপ কুমার চক্রবর্তী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “প্রথম কথা হলো-সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৫শত লক্ষ কিলোমিটার। কিন্তু আমরা যাচ্ছি মাত্র ১৫ লক্ষ কিলোমিটার। অতএব আমাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমরা সূর্যের দিকে মাত্র ১% দূরত্বে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের যন্ত্র যখন পৃথিবী ছেড়ে ওই পয়েন্টে যাবে, তখন সে সূর্যকে মাত্র ১% বড় দেখতে পাব। তাতে এমন কোনও টেম্পোরেচার হবে না যাতে যন্ত্রটির কোন ক্ষতি হয়। আমরা এল-১-এ যাচ্ছি অনেক কারণে। প্রথম কথা হলো, এল-১ পয়েন্ট এমন একটা মজার পয়েন্ট, ওই পয়েন্টটাকে পৃথিবী টানছে, ওটার একটা অভিকর্ষ বলও আছে। আবার সূর্যও ওটাকে টানছে। এতে প্রথম সুবিধা হলো-এটা থেকে সূর্যকে কন্টিনিও দেখা যাবে। অর্থাৎ এ পয়েন্টে আমরা যখন স্যাটেলাইটটা রাখব তখন এটা স্যাটালাইট থাকবে না, এটা একটা প্ল্যানেটে পরিণত হবে। অর্থাৎ পৃথিবী যেমন সূর্যের চারিদিকে ঘুরবে ওই প্ল্যানেটটাও সূর্যের চারিদিকে ঘুরবে।

এর আগে আপনারা জানেন যে, চন্দ্রে আমরা যে যান পাঠিয়েছি ওটা আগে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে তার মোমেন্টটাইম ঠিক করেছে। এখন আমরা যে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি ওটাও আগে সূর্যকে রেস্পেক্ট করবে। সূর্যকে প্রণাম জানাবে। কারণ সূর্যের গ্র্যাভেটি হচ্ছে মেইন। ওটা সূর্যের চারিদিকে ৩৬৫ দিন ঘুরবে। কারণ, সূর্য এবং পৃথিবীর যে সরলরেখা, এ সরলরেখার ওপরেই ওটা সবসময় বসে থাকে। এ কারণেই এল-১ পয়েন্টটা চুজ করা হয়েছে। সুতরাং ওটা পুড়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই।”

অতএব ভারতের এ মিশনটি সফল হলে কোনও রকম বাধা ছাড়াই ইসরোর বিজ্ঞানীরা সর্বক্ষণ সূর্যের ওপর নজর রাখতে পারবে। মহাকাশের আবহাওয়ার ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলছে সূর্য, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।